আরাকান আর্মির (এএ) আক্রমণের মুখে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যসহ (বিজিপি) ৩৩০ জন নাগরিককে ফেরত নিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের ইনানী সৈকতে সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতার পরে তাদের হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তাদের হস্তান্তর করেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুলিশ কর্নেল গুড় থোড়া নাংয়ের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বিজিপি প্রতিনিধিদল বিজিবির কাছ থেকে আশ্রয় নেওয়া ৩৩০ জন মিয়ানমার নাগরিককে গ্রহণ করেন। এদিকে বিজিপি সদস্যদের ফেরত যাওয়া দিনে রোহিঙ্গারাও নিজ দেশে ফেরার দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল ভোর পাঁচটা থেকে নাক্ষ্যংছড়ির ধুমধুম এবং টেকনাফের হ্নীলার উচ্চ বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্প থেকে ১২ টি বাসে করে আশ্রিত মিয়ানমার নাগরিকদের ইনানীতে আনা হয়। তাদের বহন করা প্রতিটি গাড়ির সামনে পেছনে দুটি বিজিবির গাড়ি পাহারা দেয়। এবং গাড়ি থেকে নামানোর সময়ও বিজিবির সদস্যরা পাহারা দেন। হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরুর আগে থেকেই সীমান্ত এলাকা এবং ইনানীতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিজিবি ছাড়াও সশস্ত্র অবস্থায় র্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিয়ানমারের পালিয়ে আসা ৩৩০ সীমান্তরক্ষীকে কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় আস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ভোর ৫টা থেকে ১২টি বাসে করে উখিয়ার ইনানী উপকূলের নৌবাহিনীর জেটি ঘাটে আনা হয়। সকাল ১১টার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ইনানীতে এসে পৌঁছলে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত সভা হয়। কথা বলেন উভয় দেশের প্রতিনিধিরা। এরপরে বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে একে একে মিয়ানমার নাগরিকদের হস্তান্তর করা হয় করেন বিজিবি মহাপরিচালক। ইনানী জেটিঘাট থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ ‘কর্ণফুলি’ ও ‘বার আউলিয়া’র মাধ্যমে গভীর সাগরে অবস্থান করা মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজে পাঠানো হয় তাদের।
বিজিবির দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩৩০ জন মিয়ানমার নাগরিকের মধ্যে ৩০২ জন বিজিপি সদস্য, ৪ জন বিজিপি পরিবারের সদস্য, ২ জন সেনা সদস্য, ১৮ জন ইমিগ্রেশন সদস্য এবং ৪ জন বেসামরিক নাগরিক। তাদের মধ্যে তুমব্রæ সীমান্ত দিয়ে ১৪৮ জন, উখিয়ার রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে ১১৪ জন এবং উলুবনিয়ার সীমান্ত দিয়ে ৬৮ জন বিজিপি সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করে বিজিবির কাছে আত্মসমপর্ণ করেন। আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে বর্তমানে ৯ জন অসুস্থ রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫ জন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ৪ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
গত ১১ ফেব্রæয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বিজিপিসহ ৩৩০ জন মিয়ানমারের নাগরিককে প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সিদ্ধান্ত মতে বিজিবি’র রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবীরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রত্যাবাসন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি মিয়ানমারের কর্তৃকপক্ষের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিজিপিসহ অন্যান্যদের প্রত্যাবাসনের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গতকাল সকালে ইনানী সৈকতে নৌবাহিনীর জেটি দিয়ে তাদের হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই গতকাল তাদের ফেরত পাঠানো হল।
হস্তান্তর কার্যক্রম শেষে বিজিবি মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘর্ষ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এই সংঘাতের কারণে প্রভাবটা এসে পড়ছে আমাদের সীমান্তেও। হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। আমরা এ ব্যপারে মিয়ানমার সকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধৈর্য ধারণ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রেখে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তাদের নিরস্ত্র করে ও অসুস্থ্যদের চিকিৎসা দিয়ে তারপরই ফেরত পাঠিয়েছি। ইতিমধ্যে সীমান্তে বিজিবির টহল ও জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থেকে কাজ করে যাচ্ছে বিজিবি। সীমান্তের পরিস্থিতি যাই হোক আর একজনও মিয়ানমার নাগরিককে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
এদিকে, বিজিপি সদস্যদের ফেরত যাওয়া দিনে রোহিঙ্গারাও নিজ দেশে ফেরার দাবি জানান। তারা বলেন, মিয়ানমারের নাগরিক হয়ে বিজিপির মতো নিজ দেশের অধিকার দিয়ে আমাদেরও নিতে হবে। যদি সরকার তাদের ফেরত নিতে পারে তবে রোহিঙ্গাদের অপরাধ কি? উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১১ এর মাঝি নুর কবির বলেন, সরকার নির্যাতন করে মিয়ানমার থেকে আমাদের বিতাড়িত করেছে। এখন বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর উপর হামলা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিজিপি সদস্যদের যদি ফেরত নিতে পারে আমরা কি অন্যায় করেছি? আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে সরকার আমাদেরও ফিরিয়ে নিতে পারে।
ক্যাম্প-১৬ এর মাঝি সুরুত আলম বলেন, প্রতিটি নাগরিক নিজ দেশে বসবাস করতে ভালবাসে। কিন্তু আমরা হতভাগ নাগরিক। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। যেভাবে বিজিপি সদস্যদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে আমাদেরও সেভাবে ফিরিয়ে নেওয়া হোক।