spot_img

ব্যারিকেড ভেঙ্গে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা গুলিতে শিক্ষার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ সাউন্ডগ্রেনেডে আহত ১

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতি ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে সময়সীমা বেঁধে (আলটিমেটাম) দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে তারা। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ‘সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের দোসর রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর (রাষ্ট্রপতির ডাকনাম) পদত্যাগের দাবিতে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার গণজমায়েত কর্মসূচির আয়োজন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেখানে প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেন অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। এছাড়া রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন আন্দোলনকারীরা।
মঙ্গলবার বিকাল থেকে কয়েকশ বিক্ষোভকারী বঙ্গভবনের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে তারা শ্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ৯ টার দিকে তারা বঙ্গভবনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এতে উত্তেজনা আরও বাড়ে। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছোড়া সাউ গ্রেনেড ও শটগানের গুলিতে তিনজন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন। আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। গুলিবিদ্ধরা হলেন- ফয়সাল আহম্মেদ বিশাল ও শফিকুল ইসলাম (৪৫)। সাউন্ড গ্রেনেডে আহত তরুণের নাম আরিফ (২০)। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ফয়সাল আহম্মেদ বিশাল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
গতকাল রাত সাড়ে ১০ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফয়সাল গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করি। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাধার মুখে পড়ি। ওখানে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ ছররা গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এ সময় ছররা গুলি আমার পায়ের গোড়ালিতে ও কোমরের নিচে লাগে।
গুলিবিদ্ধ অপর ব্যক্তি শফিকুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে সংহতি প্রকাশ করে আমরা বঙ্গভবনের সামনে এসেছিলাম। আমি ব্যবসা করি। এক শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে আমার ডান পায়ে ছররা গুলি লাগে।
আহত আরিফ পড়েন সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। তিনি বলেন, আমরা বঙ্গভবনের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করছিলাম। ভেতরে ঢুকতে চাইলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি চালায়। এ সময় আমার পায়ের ওপর একটি সাউন্ড গ্রেনেড এসে পড়ে। এতে আমি আহত হই।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, বঙ্গভবনের সামনে থেকে আহত অবস্থায় তিনজন এসেছেন। এদের মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ। জরুরি বিভাগে তাদের চিকিৎসা চলছে।
বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা বিক্ষোভকারীদের : মঙ্গলবার রাত ৮টা ২০ মিনিটে মাইকে ঘোষণা দিয়ে একদল বিক্ষোভকারী ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে সেনাবাহিনী। পরে বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে সাউন্ডগ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। তবে তারা আবারও জড়ো হন। এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে সেখানে এক ভ্যান পুলিশ আসে। তবে আন্দোলনকারীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ শ্লোগান দিয়ে তাদের বঙ্গভবনের ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে একটি জলকামান এলেও আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের মুখে তা দৈনিক বাংলা মোড়ের দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়।
শহিদ মিনারের সমাবেশ ঃ
শহিদ মিনারের সমাবেশে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘যে শহিদ মিনার থেকে আমরা এক দফা ঘোষণা দিয়েছিলাম, সেখান থেকে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করতে চাইছি। আমাদের প্রথম দফা, যে সংবিধানের মধ্য দিয়ে চুপ্পু বলবৎ রয়েছে, এই মুজিববাদী বাহাত্তরের সংবিধানকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সেই সংবিধানের জায়গায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে।’
তাদের ঘোষিত অন্য চার দফা দাবি হচ্ছে: এই সপ্তাহের মধ্যে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলার মাটি থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ফ্যাসিবাদের সংবিধানের দোসর রাষ্ট্রপতি চুপ্পুকে এই সপ্তাহের মধ্যে পদচ্যুত করতে হবে। অভ্যুত্থান ও জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের আলোকে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা করতে হবে এবং এর ভিত্তিতে দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এই তিন নির্বাচনে যারা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তারা যেন ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক না হতে পারেন ও নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাসনাত বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যে আমরা নিশ্চিত করতে চাই, ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদী চেতনার সব সাংস্কৃতিক সংগঠন, মিডিয়া সংগঠন, মুজিববাদী মিডিয়া ও সংস্কৃতি, মুজিববাদী সংবিধান, মুজিববাদী জীবনাচারণ এই বাংলার মাটি থেকে স্থায়ীভাবে উৎখাত হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মাদার অব টেরর খুনি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার স্বপ্ন ভুলে গিয়ে নিজেরা অবিলম্বে বিচারের আওতায় চলে আসুন। তাকে আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসব। তবে সেটা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর জন্য।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বিপ্লব শেষ হয়ে যায়নি। ৫ আগস্ট আমরা মাফিয়া শেখ হাসিনাকে উৎখাত করেছি। কিন্তু এখনো আমরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। অনেক রাজনৈতিক দল গত ১৬ বছর ধরে নির্যাতিত-নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়েছে। জামায়াত, ডানপন্থি, বামপন্থি, উভয়পন্থিÑযে মতাদর্শেরই হোক না কেন, যারা বাংলাদেশের প্রশ্নে আপসহীন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য যারা রাজনীতি করেন, যত দিন না তাদের সুস্থ ও গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারছি, তত দিন পর্যন্ত আমাদের বিপ্লব শেষ হয়ে হবে না। এই সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ দফা বাস্তবায়ন না হলে আমরা রাস্তায় নেমে আসব। অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বলতে চাই, আপনারা সরকার হয়েছেন। কিন্তু পেছনে মুজিবের ছবি না লাগিয়ে ৫ আগস্টের গণভবন, বঙ্গভবন ও সংসদের ছবিটি প্রত্যেকের কক্ষের সামনে লাগিয়ে রাখবেন। মনে রাখবেন, যখনই সরকার জনমুখী না হয়ে ক্ষমতামুখী হয়, তাদের অবস্থা ঠিক ঐ সংসদের মতো হবে।’
সমাবেশে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর খুনি হাসিনা ও তার কোনো দোসর গর্ত থেকে বের হওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে ছাত্র-জনতা আবার ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামবে। রাষ্ট্রপতি চুপ্পু ৫ আগস্টে পুরো জাতির সামনে বলেছিলেন, খুনি হাসিনা তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এখন তিনি বলছেন, তার কাছে পদত্যাগপত্র নেই। চুপ্পুসহ ফ্যাসিবাদের সব দোসরকে একটি কথা বলে দিতে চাই, ফ্যাসিস্টদের উৎপাত দেখা গেলে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিরোধ করবে। প্রয়োজন হলে আবার আমরা রক্ত দিতে প্রস্তুত, এমনকি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’
সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের মূল হচ্ছে মুজিববাদ। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রথম হামলা করেছিল সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার শুরুটাও হয় এই ছাত্রলীগ দিয়ে। তাই এই সন্ত্রাসী মুজিববাদী ছাত্রসংগঠনকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে।’ সমন্বয়ক লুৎফর রহমান রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলেন, ‘ন্যূনতম সম্মান থাকলে পদত্যাগ করে রাষ্ট্রপতি পদকে মুক্ত করুন। চুপ্পুর পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।’
সমন্বয়ক রিফাত রশীদ বলেন, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে সন্ত্রাসী, জঙ্গি সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা না হলে জনগণ নিজেদের ম্যান্ডেট দিয়ে তাদের নিষিদ্ধ করে দেবে। পতিত ফ্যাসিবাদের অনেক দোসর ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিল, যার পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমরা পাইনি। সেনাপ্রধান সেই ৬২৬ জনের তালিকা এই সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ না করলে ফলাফল ভালো হবে না। তাদের নাম অবিলম্বে প্রকাশ করুন, তাদের মধ্যে কারা আটক হয়েছে, তার তালিকা দিন।’ সমন্বয়ক আশরেফা খাতুন জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকান্ডের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণজমায়েত কর্মসূচিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাকর্মীরাও অংশ নেন। এতে নাগরিক কমিটির আহŸায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছিÑবাংলাদেশে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যারা ছাত্র-জনতার ওপর গুণ্ডাগিরি চালিয়েছে, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সেই ক্ষমতার অংশ। আমরা অবিলম্বে খুনি হাসিনার এই দোসরের পদত্যাগ দাবি করছি। দ্বিতীয়ত, আমরা বাংলাদেশে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে গতকাল বিকালে বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি ব্যানারে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে পৃথকভাবে বিক্ষোভ করেন। এর মধ্যে ইনকিলাব মঞ্চের ব্যানারে ছাত্ররা, রক্তিম জুলাই ’২৪- এর ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা, ৩৬ জুলাই পরিষদ ব্যানারে একদল মানুষ, জিয়াউর রহমান সমাজকল্যাণ পরিষদের ব্যানারে একদল মানুষ, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার মঞ্চের ব্যানারে কিছু মানুষ বিক্ষোভ করেন। সব মিলিয়ে শতাধিক মানুষ সেখানে বিক্ষোভে অংশ নেন। তারা শ্লোগান দেন, ‘এক দফা এক দাবি, চুপ্পু তুই কবে যাবি’। তাদের ভাষ্য, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ