রেলের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি করা হলেও বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় অবহেলার শিকার হয়েছে রেলপথ। বিভিন্ন সময়ে মূখরোচক প্রকল্পের নামে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। মন্ত্রনালয় থেকে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা যা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এযেন মোল্লার গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেইর মত অবস্থা। তাইতো বড় বড় প্রকল্পের অতিক্ষুদ্র অংশ রেল পরিষেবা বাড়ানোর কাজে ব্যয় হয়েছে। বরাদ্দের বড় অংশ লুটপাট আর বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে বিকলাঙ্গ হয়েছে রেল। বর্তমান সরকার রেলের এই বাগাড়ম্বর বিষয়ে তদন্তে করতেই বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। ঋণের নামে এসব বিনিয়োগ রেলকে শক্তিশালী করেনি উপরন্ত দিনকে দিন রেলকে বিকলাঙ্গ করে ফেলেছে। তাইতো রেলপথ মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টাকে বলতে হচ্ছে বিনিয়োগের সুফল পেতে আমাদের আরও দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে।
বর্তমানে প্রায় ৪০০ ট্রেন পরিচালনা করছে রেলওয়ে। এসব ট্রেনের বিপরীতে সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৭১। স্বভাবতই ইঞ্চিনস্বপ্লতায় (লোকোমোটিভ) ভুগছে সংস্থাটি, যার কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিচালনা কার্যক্রম। বহরে থাকা ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে সিংহভাগেরই শেষ হয়েছে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ৯৫টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। একের পর এক রেললাইন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু যে পরিমান ট্রেন চলার কথা ছিল, তার বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে রেললাইন নির্মাণের সুফল সেই অর্থে মানুষ পায়নি। অন্যদিকে আগে থেকে যে রেললাইন চালু আছে, সেখানে ট্রেনের শিডিউল বা সময়সূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। লুটপাট অদক্ষতা রেলপথ সংস্কারের অনিয়মসহ নানা কারণে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের বড় কাজ এখন রেলের সময়সূচিতেশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা একই সঙ্গে রেলকে গণমুখী পরিবহনে পরিণত করা। বর্তমান সময়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ট্রেনগুলোর গন্তব্যে পৌঁছাতেও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশী সময় লাগছে। এতে যাত্রীদের যেমন বাড়তি সময় কস্ট করতে হচ্ছে তেমনি ভোগান্তির সঙ্গে রেলের খরচ বেড়েছে। তবে বর্তমান অর্ন্তবর্তী কালীন সরকার জন দুর্ভোগ লাঘবে সক্রিয় বিধায় পুর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ এই বিলশ্বকে বিশেষ বিবেচনায় এনেছে। তাই তারা ট্রেন চলাচলের সময়সূচি সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ সংস্কারে নেই কার্যকরী প্রকল্প। লোকসান আর ঝুঁকি নিয়েই চলছে ট্রেন, কেন মিলছে না সুফল? আকাশছোঁয়া বিনিয়োগের পরও প্রতিষ্ঠানের লোকসান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচের পরও ট্রেনের গতি তো বাড়েইনি, উল্টো কমেছে। এখনও দেশের ৬০ শতাংশ রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ আর ৭০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়েই যাত্রী পরিবহনের কাজটি সারা হচ্ছে।
প্রাপ্ততথ্যে জানা যায়, বর্তমানে সংস্থাটির বহরে থাকা মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা ৩০৭। এর মধ্যে ১৯৭টি ইঞ্জিন মিটার গেজ, যার সিংহভাগই চলাচল করছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে চলাচল করছে ১১০টি ব্রড গেজ ইঞ্জিন। বর্তমানে প্রায় ৪০০ ট্রেন পরিচালনা করছে রেলওয়ে। এসব ট্রেনের বিপরীতে সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৭১। স্বভাবতই ইঞ্জিনস্বপ্লতায় ভুগছে সংস্থাটি, যার কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক পরিচালনা কার্যক্রম।অন্যদিকে বহরে থাকা ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে সিংহভাগেরই শেষ হয়েছে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল। রেল ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারিত থাকলেও অধিকাংশ ইঞ্জিনের বয়স পেরিয়ে গেছে ৪০ বছর। পুরনো এসব ইঞ্জিনে কাঙ্খিত গতিতে চলতে পারছে না সিংহভাগ ট্রেন, কমেছে ইঞ্জিনের কর্মঘণ্টা।
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে চলা যাত্রী পরিবহন বিষয়ে চলকদের নানান অভিযোগ রয়েছে। চালকরা বলছেন, কোনো কোনো রুটে ট্রেনের গতি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। তারা জানান, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। রেলগাড়ির ইঞ্জিন হিসেবে ৩০ থেকে ৪০বছর আগের মেয়াদউর্ত্তীন ইঞ্জিন ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরানো হওয়ার কারণে নানান সমস্যা লেগেই থাকে। এছাড়া পরিস্থিতি অনুযায়ী কোথাও গতিসীমা ৩০ আবার কোথাও ১০ করে চালাতে হয়।
রেলের এই হাল দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের খেসারত দিচ্ছে রেল। এমন কান্ডে প্রতিবছর ভারী হচ্ছে রেলের লোকসানের পাল্লা। এ জন্য দরকার সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ড. হাদীউজ্জামান গণম্যাধ্যমকে জানান, ‘বিনিয়োগের যে প্রাধিকারের বিষয়টি আছে, সেটি কিন্তু রেল দিতে পারেনি। রেলের নীতি নির্ধারকরা চরম বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। কোনটি আগে করার কথা আর কোনটি পরে করার কথা, সেই বিষয়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। জনগণ যেখানে সেবা পাচ্ছে না, তারপরেও ওই ঋণের বোঝাও জনগণকেই বইতে হচ্ছে বা হবে।’
তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, বিনিয়োগের সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও। উপদেষ্টার কথায়, রেলের বিনিয়োগ এবং এটার সুফলটা তো এত দ্রæত পাওয়া সম্ভব নয়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমানে রেলের ৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। অর্ন্তর্বতীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সময় মেনে ট্রেন চলাচলসহ সেবার সার্বিক মান বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রেলের সূচি বিপর্যয় কমিয়ে আনা, টিকিট কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ, বিনা টিকেটের যাত্রী প্রতিরোধ, রেলের ব্যয় সংকোচন করে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়সহ রেলকে লাভজনক পর্যায়ে নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এখন নির্দেশনাগুলো কতটা বাস্তবায়ন হয়, সেটিই দেখার অপেক্ষা। আমরা আশা করব,একটা সময় রেলযাত্রার প্রতি মানুষের যে আস্থা ছিল, সেটি ফিরে আসবে।