রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কথা হয় মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা। ৩১ বছর বয়সি এই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বলেন, প্রচন্ড জ্বর আসে গত শনিবার, জ্বর ছিল ২০৩ ডিগ্রী। সাথে মাথা ব্যথা, গাঁয়ে ব্যথা। জ্বরের ঔষধ নাপা খেয়েও জ্বর কোনভাবেই ছাড়চ্ছিল না। সোমবার ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে দিই, মঙ্গলবার ডেঙ্গু পজেটিভ আসে এবং রক্তের প্লাটিলেট কম থাকায় চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। এখন ধীরে ধীরে প্লাটিলেট বাড়ছে। জ্বরও কমে গেছে। দূর্বলতা আছে। আজ তিন দিন হাসপাতালে ভর্তি আছি, বেশ সুস্থ্য মনে হচ্ছে বলে জানান।
তাবরেজ আলাল আদিল, বয়স ১৩ বছর বয়সি আদিলের মা লিজা বলেন, আগে আদিলের বাবার জ্বর আসে তিনিও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। একটু সুস্থ্য হতে না হতেই আদিল আক্রান্ত হন, আদিলের জ্বরের সাথে বমি ছিল, আর মুখে খেতে পারছিল না। টেষ্টে ডেঙ্গু পজেটিভ আসে এবং আদিলের প্লাটিলেট কমতে থাকে। ফলে ছেলেকে নিয়ে দ্রæত মিরপুর-১ থেকে হাসপাতালে চলে আসি। এখন প্লাটিলেট বাড়ছে। হাফিজুর রহমান রিয়াদ, বয়স ২৩ বছর, শিক্ষার্থী। থাকেন ফার্মগেট একটি মেসে। তিনি বলেন, সাতদিন হলো হাসপাতালে ভর্তি আছি। আমার প্রচন্ড জ্বর ছিল, সঙ্গে পেটে ব্যথা এবং দাতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়ছিল। তখন হাসপাতালে ভর্তি হই। এখন মোটামুটি ভালোর দিকে।
তবে হাসপাতালে আদিল, আসাদুজ্জামান বা রিয়াদ কেহই মশারীর ভেতরে ছিলেন না। জানতে চাইলে রোগীরা বলেন, গরমের কারণে মশারী খুলে রেখেছি। মশা নেই, রাতে আমরা মশারী টাঙ্গিয়ে ঘুমাই। দেশে পাল্লা দিয়ে যেখানে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং মৃত্যুর সারি ধীরে হলেও দীর্ঘ হচ্ছে। তারপরেও সচেতনতা অভাব দেখা যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজনদের মধ্যে।
ডেঙ্গু ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা ডা. অনিক বিশ্বাস বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ আছেই। যেহেতু এটা ডেঙ্গু জ্বরের সিজন, সেক্ষেত্রে রোগী আছে, তবে আমরা সব ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিচ্ছি না। যাদের জটিলতা দেখছি, বা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি রাখছি। আমাদের নতুন করে ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু হয়েছে। সেখানে ৫৩ টি বেডেই রোগী ভর্তি রয়েছে। তবে মৃত্যু নেই বললেই চলে।
জানা যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ সেপ্টেম্বর নতুন করে ডেঙ্গু ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। সেখানে ১৪ আগষ্ট একজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়। তবে তার অন্যান্য রোগের জটিলতা ছিল বলে জানান হাসপাতালের সিনিয়র নার্স আব্দুল খালেক।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুয়ায়ি, চলতি বছর ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২ হাজার ২৬৫ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১২৪ জনের। এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। গত ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৯৯ জন।
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইডিসিআর)-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, প্রকৃতিতে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও আদ্রতার কারণে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ঢাকার বাইরেও মশা ছড়িয়ে পড়ছে। রোগী বাড়ায় মৃত্যু বাড়ছে। তবে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। সেই তুলনায় এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কম। এবার জুলাই থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে চলতি সেপ্টম্বরে ডেঙ্গুর পিক (সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়) চলছে। তবে অক্টোবরের পর এটা স্পষ্ট করে বলা যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সে কারণে মশার প্রজনন কেন্দ্র ধ্বংস করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষনের বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেঙ্গুতে জ্বরের পাশাপাশি মাথা ব্যথা, চোখে ব্যথা বা আই বলে ব্যথা হবে। তবে এ ধরনের ব্যথা ইনফ্লুয়েঞ্জারেও হতে পারে। এখন যখন ডেঙ্গুর সিজন, তাই জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎক দেখে বুঝবেন এবং এনএস-১ পরীক্ষা করে দেখতে হবে ডেঙ্গু পজেটিভ না নেগেটিভ। তবে ডেঙ্গু পজেটিভ হলে চিকিৎকের অবজারভেশনে থাকতে হবে। দুই-তিন দিন পরে রোগীর আইজিজি ও আইজিএম পরীক্ষা করে দেখবেন যে তার ডেঙ্গু এই প্রথম হয়েছে, না সেকেন্ডারি। ডেঙ্গু রোগীর শরীরে আইজিজি এন্টিবডি থেকে যায়, ফলে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলে তা মারাতœক হয়। তিনি বলেন, আমার মতে, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হওয়া রোগীকে হাসপাতালেই অবর্জারভেশনে রাখা প্রয়োজন। কারণে এদের মধ্যে মৃত্যু বেশি হয়। প্রাইমারী ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে।