দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে বাংলাদেশে। এছাড়া এশিয়ার মধ্যে চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জাপানের পর্যটকদের আকর্ষনের জায়গা বাংলাদেশ। এশিয়ার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, তুরস্ক এবং রাশিয়া থেকেও পর্যটক বাংলাদেশে ঘুরতে আসেন। দেশীয় অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতে মহাপরিকল্পনা নেয়া হলেও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে পর্যটকসহ পর্যটন এলাকাগুলোর নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের স্বল্পতা নিরাপত্তার সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতে দুই তরুণীকে মারধর-ওঠবস করা হচ্ছে, তাকে ঘিরে রেখেছেন কয়েকজন তরুণ-যুবক। এমন হয়রানির তিনটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। যা পর্যটন শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ সক্রিয় থাকলে এমন অনাখাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটত না।
গত কয়েক বছর ধরেই পর্যটন স্পটগুলোতে নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় পর্যটকদের মধ্যে দ্বিধা ও সংশয় তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটন খাতের উন্নয়নে পর্যটন এলাকাগুলোতে নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের জনবল বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট জিডিপির সাড়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালদ্বীপের পর্যটন খাত থেকে আসা আয় জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া শ্রীলঙ্কার সাড়ে ১২ শতাংশ, নেপালের ৬ শতাংশ, ভুটানের সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ভারতের সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি জিডিপির আয় আসে পর্যটন থেকে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের পর্যটনের বড় একটি আয় আসে দেশের ভেতরে থাকা পর্যটক থেকে। বিদেশি পর্যটক থেকে বাংলাদেশ গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর আয় করে, যা একটি মজবুত পর্যটন খাতের জন্য অপ্রতুল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে প্রায় এক হাজারের মতো পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বছরে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ পর্যটক এসব স্পটে ভ্রমণ করেন। অথচ এই পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৩০০ জন। হিসাব কষে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ হাজার পর্যটকের নিরাপত্তায় রয়েছে মাত্র একজন ট্যুরিস্ট পুলিশ। বিশেষায়িত এই পুলিশে জনবল সংকটের কারণে স্পটগুলোতে যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা কিংবা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলাতে সাধারণ পুলিশকেই ছুটতে হয়। এতে অনেক সময় জটিলতা দেখা দেয়।
তথ্যমতে, দেশে অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় সম্ভাবনা বেড়েছে পর্যটনশিল্পে। এই খাতকে এগিয়ে নিতেই ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৬৯৯ সদস্য ও কর্মকর্তা নিয়ে দেশে প্রথম যাত্রা শুরু করে ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিট। বছর দুয়েক পর ২০১৫ সালে এসে পর্যটন স্পটগুলোতে ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। তবে বিগত প্রায় অর্ধযুগ ধরে পর্যটন খাতে সম্ভাবনা বাড়লেও জনবল নিয়োগে কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে জনবল সংকটে পর্যটন খাতের নিরাপত্তায় পুলিশের এই বিশেষায়িত ইউনিট অসহায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিপুলসংখ্যক ট্যুরিস্ট পুলিশের দরকার। সেজন্য পুলিশের ট্যুরিস্ট ইউনিটে জনবল নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে পর্যটকসহ পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলা সম্ভব হবে না। আর তাতে সম্ভাবনা অনেক ধূসর হয়ে যেতে পারে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের সংকটে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) এর প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরেফ বলেন, সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে কক্সবাজারে তারা ভালোভাবেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে তাই নয় সেফটির বিষয়টাও তারা প্রাধান্য দিচ্ছে। পর্যটকদের সেবা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে এবং দেশের বিভিন্নপর্যটন এলাকা প্রমোট করার জন্য তারা কাজ করছে। এর ব্যাপ্তি আরো ব্যাপক হতে পারে। গত বছরও দেখেছি, তারা ট্যুরিস্টদের সেবায় হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর, হান্টিং নম্বর, অ্যাপস এসব বিষয় ইনট্রোডিউস করেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ এর ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি মো. তোয়াহা চৌধুরীও একই মত দিলেন। তার মতে, সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়ে পর্যটকদের ভালোই নিরাপত্তা দিচ্ছে। পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটের সব তৎপরতাই পর্যটকদের কেন্দ্র করে। প্রথমত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে অবহিত করে, বিভিন্ন স্পটের তথ্য জানিয়ে দেয়, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যায় এবং পদক্ষেপ নেয়, তবে তাদের জনবল সংকট বাড়ানো দরকার।
ট্যুর অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) এর সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী বলেন, মাত্র ১ হাজার ৩০০ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ আমাদের বিস্তৃত পর্যটন এলাকা নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা বাস্তবে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। পুলিশের কার্যক্রমের সঙ্গে কমিউনিটিকে সংযুক্ত করলে পর্যটন খাতে নিরাপত্তা দেয়া অনেকটা সহজ হবে।
জনবল বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি আবুল কালাম সিদ্দিকী বলেন, আমাদের সম্ভাবনার পাশাপাশি প্রচুর সীমাবদ্ধতাও আছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে, যাতে পর্যটকদের স্বস্তি দেয়া যায়। তাই যা লোকবল আছে তা-ই নিয়ে লড়ছি। তবে প্রয়োজনে জেলা পুলিশের সহায়তা নিয়ে কাজ করছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে দেশি-বিদেশি সব ধরনের পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে কেবল লোকবল নয়, পর্যটন-সংক্রান্ত অনেক কিছুরই প্রয়োজন। তবে জনবল বাড়ানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অরগানোগ্রাম পাঠানো হয়েছে। আশা করছি শিগগির ট্যুরিস্ট পুলিশের জনবল বাড়বে এবং পর্যটকদের বিস্তৃত সেবা ও নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে। ট্যুরিস্ট পুলিশ টিমকে নিয়মিত সদাচরণ, ভালো ব্যবহারের ট্রেনিং দেয়ার মাধ্যমে গড়ে তোলা হচ্ছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।