তিনদিনের সফরে আজ শনিবার ঢাকায় আসছে উচ্চপর্যায়ের একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল। দুই দেশের ভবিষ্যত সম্পর্ক জোরদারের এই সফরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিভিন্ন খাতে সহায়তার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান সংকট উত্তরণের চাহিদাগুলো জানতে চাইবে ওয়াশিংটন। একইসঙ্গে বিষয়গুলোতে সামনের দিনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা করবে দুই পক্ষ।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি দলের প্রথম ঢাকা সফর। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বলতে গেলে অস্বস্তির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। গণতন্ত্র-মানবাধিকারের মতো ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বারবার উদ্বেগ জানালেও তা আমলে নেয়নি শেখ হাসিনা সরকার। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু দুইদিনের সফরে ঢাকায় এলেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও সঙ্গে তার কোনো বৈঠক বা কথাবার্তাও হয়নি। কিন্তু গত মাসে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি সহযোগিতার প্রতিশ্র“তি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসছে আলোচনার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দফতরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু ছাড়াও থাকছেন দেশটির আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কাউর ও সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। তারা আজ আলাদাভাবে ওয়াশিংটন ও দিল্লি থেকে ঢাকায় আসবেন। আজই তারা একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। আগামীকাল রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবে প্রতিনিধি দলটি। দুপুরে তারা পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। বিকেলে প্রতিনিধিদলের নেতা ব্রেন্ট নেইম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত ইতিবাচক পরিবেশে মার্কিন দলের বৈঠক হবে বলে আশা করছেন সরকারের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রতিনিধি দল আসছে, তারা যে এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় সেটির বড় প্রতিফলন ঘটছে এর মাধ্যমে। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের পরিচয় দেখলে বোঝা যায় এই আলোচনা বহুমাত্রিক হবে। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মধ্যে সীমিত থাকবে না। আমরাও এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
অর্থনীতি ও সংস্কারে সহায়তায় জোর দেবে ওয়াশিংটন
প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মার্কিন রাজস্ব ও অর্থ দফতরের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। স্বাভাবিকভাবে এবারের সফরে প্রধান্য পাবে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, প্রতিনিধি দলটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে কিভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করা যায়, সেটি নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
স¤প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদী যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে সক্ষম হবে এবং নিরবচ্ছিন্ন প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারবে। তিনি জানান, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পৃক্ততা, যুক্তরাষ্ট্র তাতে সমর্থন দেবে। আর্থিক খাতের গভীর সংস্কার, দুর্নীতি হ্রাস ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চায়, তাতেও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কয়েকটি ক্ষেত্রে মার্কিন অর্থ দফতরের বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত সংস্কার, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতে নজরদারির মতো বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী তারা সহায়তা দিতে প্রস্তুত। সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশকে যেকোনও ধরনের কারিগরি সহায়তা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিতে রাজি আছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে তাদের কাছে সমস্যাগুলো তুলে ধরা সম্ভব হলে তারা সহায়তা করবে। যেমন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সহায়তা চাইলে তারা সহায়তা করবে।
সাধারণত অন্য দেশকে ঋণ দেয় না যুক্তরাষ্ট্র। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন হওয়ার কারণে বিষয়টি অনেক জটিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেমন- বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে সহায়তা করতে পারে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সহায়তা করা, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করে নতুন বিনিয়োগের পথ সুগম করতে চায় দেশটি।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা চায় যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিসেবে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আজ দুপুরে ঢাকায় আসবেন। তিনি দিল্লিতে সফর শেষ করে ঢাকায় আসছেন। দিলিতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বৈঠকে যোগ দেন তিনি। ক‚টনৈতিক সূত্র মতে, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরবর্তী পরিস্থিতিকে ভারত যেভাবে দেখছে, একইভাবে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দিতে চায়। ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা, ঢাকার সঙ্গে সহযোগিতার পথেই থাকবে দিল্লি। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতকে বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের স্বার্থে বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ নিয়মিতভাবে চালু থাকাটা জরুরি বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র।