spot_img

তিন যুগে দিকদর্শন প্রকাশনীর সফলতা নিয়ে কথোপকথন

পার্ট : ১
সম্প্রতি দিকদর্শনের স্বত্বাধিকারী আর. সি. পাল-এর দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বই হলো মানুষের অনুভ‚তির ঘরেপ্রবেশ করার অন্যতম চাবি। এ অনুভ‚তির চাবিটা টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া,রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে দিকদর্শন প্রকাশনী। ১৯৯৩ সালে দিকদর্শনের যাত্রা শুরু হয়। জন্মলগ্ন থেকে অনার্স ও মাস্টার্সের সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ডিগ্রি এবং চাকরির বইসহ অনেক বইয়ের প্রকাশক দিকদর্শন। এর পাশাপাশি দিকদর্শন ও গ্রন্থকুটির নামে আরো একটি প্রকাশনার মাধ্যমে এইচএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত দিকদর্শন পাঠ্য বই প্রকাশ করেছে। ২০১১ সাল থেকে আমরা পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল অর্থাৎ গল্প, উপন্যাস,প্রবন্ধ সৃজনশীলসহ বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতির উপর প্রকাশনা নিয়মিত চলমান রয়েছে।
সফলতা বলতে ১৯৯৩ সালে অনার্সের সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ করি। ঐ সময়টাতে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের চত্বরে এবং ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজে বহু লোকজন টেবিল নিয়ে মাস্টার্স প্রিলিমিনারি ও ফাইনাল বিষয়ের গাইড বিক্রি করতো।
পার্ট : ২
প্রতিবেদককে আর. সি. পাল বলেন, তখন জগন্নাথ বুক সেন্টার নামে ছোটোখাটো লাইব্রেরি ছিলো। ওখানে দেখলাম প্রিলিমিনারির ৪/৫ টা বই ছিলো এর সাথে অনার্স বইয়ের সাথে সিলেবাসের মিল থাকায় অনার্সের গাইডগুলো প্রিলিমিনারির ছাত্রছাত্রীরা নিতো।তখন আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি তো অনার্সে পড় প্রিলিমিনারির বই কেনো নিচ্ছ? সে জবাব দিলো- আমাদের সিলেবাসের সাথেএর হুবহু মিল আছে।তখন আমি চিন্তা করলাম অনার্সের গাইড বা সহায়ক গ্রন্থ বের করলে চলবে।
সে ভাবনা থেকেইঅনার্স কোর্সের বিভিন্ন সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ করি। অনার্সের সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ করার পর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সিলেবাস অনুসরণে গ্রন্থ প্রকাশ করা হয় এবং পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াতে সারা বাংলাদেশে একই সিলেবাস হয়। তখন প্রতি জেলা ও উপজেলায় দিকদর্শনের গাইডগুলো পৌঁছে দেয়া হলো। ছাত্রছাত্রীবৃন্দ গাইডগুলো হাতে পাওয়ার পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হলো। ১৯৯৩-২০০১ সাল পর্যন্ত অনার্সের সহায়ক বইগুলো লম্বা গাইড আকারে করেছি যার নাম দিয়েছিলাম হ্যান্ডবুক।
আর. সি. পাল বলেন, ২০০১ থেকে ২০০২ সালের দিকে গাইডকে প্রিন্টেট বই হিসেবেপ্রকাশ করা হয়। এরপর ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবকদের মাঝে সমাদৃত হয়।এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয় মেজর ও ননমেজর। নন মেজর হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি, সমাজবিজ্ঞান, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি, সমাজকর্ম। ওদিকে সায়েন্সের থিসিস যারা পড়ে কেমিস্ট্রি তাদের নন মেজর – যারা কেমেস্ট্রি পড়ে থিসিস তাদের নন মেজর। ম্যাথ কম্পালসারি নন মেজর। এই বইগুলো আলাদা করে যখন যে সিলেবাস ছিলো তখন সেভাবে প্রকাশ করি। এভাবে ছাত্রছাত্রীদেরমধ্যে দিকদর্শন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আর. সি. পাল আরো বলেন,যাই হোক দিকদর্শনের একটা বিশাল মার্কেট ছিলো ২০১৩ সাল পর্যন্ত। দিকদর্শনকে দেখে অনেক প্রকাশনী যাত্রা শুরু করে। কিন্তু পরে দেখা যায় এক দুই বছর থাকার পর অনেকেই মার্কেট থেকে চলে যায়।এভাবেই যুগ পরিক্রমায়যথারীতি চলতে থাকে দিকদর্শন। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দিকদর্শন টিকে আছে। তবে আগের মতো ভালো অবস্থানে নেই।
আর. সি. পাল প্রতিবেদককে বলেন, ভালো না থাকার কারণ কোভিড-১৯। কোভিড-১৯-এর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অটোপাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও বিভিন্ন কারণে ছাত্রছাত্রীদের বই বা সহায়ক গ্রন্থ বা গাইডের প্রতি অনিহা দেখা দিয়েছে। এখন সবচেয়ে যে জিনিসটা ভাববার বিষয় তাহলোÑ ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার ২ থেকে ৪ দিন পূর্বেই বই কিনে সেই বই ফেরত দিয়ে সেকেন্ড ইয়ারের বই নিয়ে যায়।এসব নানান কারণে শুধু দিকদর্শনই না প্রকাশনার জগতটাই যেনো নিস্তেজ হয়ে গেছে। উপরন্তুপ্রাইমারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসার সব বই বিনামূল্যে সরকার দিচ্ছে। নানান কারণে লাইব্রেরির সংখ্যাও কমে গেছে। শোনা যাচ্ছে সিলেবাস পরির্বতন করা হবে। যাই হোক, পরিবর্তিত সিলেবাসের আলোকে আমরা ছাত্রছাত্রীদেরকে আগের মতই পূর্ণাঙ্গরূপে বইগুলো দিতে পারবো বলে প্রত্যাশা।
পার্ট: ৩
আর. সি. পাল সরকারও শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, যে ধরনের পলিসি বাস্তবায়ন করলে ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন অনুসরণ না করে, বরং বইমুখী হয় সে বিষয়গুলো যেন ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তুলে ধরা হয়।
২০১৩ সাল থেকে বই মেলায় অংশগ্রহণ করি। শিশুতোষ প্রকাশনার জন্য আছে শিশু গ্রন্থকুটির, আর বড়দের জন্য আছেগ্রন্থকুটির নামে। তবে প্রতিবছর শিশুদের বইয়ের চাহিদা বেশী থাকে। আমরা চেষ্টা করি শিশুদের বইগুলোর মূল্য কম রাখার জন্য। ২০২৪ সালের একুশেবই মেলায়ও অংশগ্রহণ ছিলো। বিক্রি একেবারে খারাপ ছিল না। অনেকটাই আশঙ্কায় ছিলাম স্মার্টফোন সবার হাতে থাকায় হয়তো বই কিনবে না। কিন্তু মোটামুটিভাবে প্রতিবছরের মতো এবারও বই মেলায়গ্রন্থকুটির ও শিশু গ্রন্থকুটির-এর বইয়ের চাহিদা ছিলো। একশ্রেণির পাঠক আছেনযারা ভালো লেখক এবং ভালো মানের বই খুঁজে নেন। এবারের বই মেলায় আমাদের ১০/১২টি উপন্যাসেরচাহিদা বেশী ছিলো। তার মধ্যে তিন গোয়েন্দা, হরর কাহিনি অন্যতম।
আমার প্রথিতযশা শিক্ষক ও বই অনুরাগী বিদগ্ধজনদের প্রতি অনুরোধ থাকবে আপনাদের ছেলে মেয়েদেরকে বই মেলায় আসতে উৎসাহিত করুন এবংপ্রত্যেককে অন্তত: দুটি করে বই কেনার উপদেশ দিন। আসলে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই হয়ত আপ্তবাক্য রয়েছেÑ
“পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বইঅন্ধকারে রই।”
“বই পড়ো, জীবন গড়ো।”
পার্ট : ৪
আর. সি. পালের ছোটো বেলায় বইয়ের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিলো। রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা বইগুলো অনেক পড়তেন। মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আত্মীয় স্বজনদের গিফটের টাকা দিয়ে ফেনী শহরে এসে পুরাতন বই কিনতেন। বইয়ের জন্য এতো পাগল ছিলেন তিনি; যার জন্য তিনিআজ দেশের একজন সেরা প্রকাশক।
সৃজনশীল প্রকাশনার জন্য গতবছর দশজন বাছাই করা লেখক ছিলেন, সামনের বছর আরো পাঁচজন লেখক বাড়বে আশা করি। ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি গল্প, প্রবন্ধ, ছোটো গল্প, গোয়েন্দা কাহিনি, হরর কাহিনি বিষয়াবলির উপর লেখক ও লেখা সংগ্রহের জন্য। এছাড়াও দিকদর্শন মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ-সংস্কৃতি, নারী আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন বিষয়কঅনেক বইয়ের প্রকাশক।বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পটভূমি নিয়ে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করা হয়। তবে যে বইগুলোর এখনো চাহিদা আছে সেই বইগুলো আমরা পাঠকের জন্য আবার প্রকাশ করবো।অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের তুলনায়বইয়ের মূল্য আমরা কম রাখি। দিকদর্শনের প্রতিটিবইর মূল্যের ক্ষেত্রে পাঠকেরআস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। আর একটা বিষয় হলো গতবছর বই মেলার প্রাক্কালে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে; যার ফলে ব্যবসায়ীদের সমস্যায় পড়তে হয়। দিকদর্শন সফলতার তিন যুগের মধ্যে অসংখ্য গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে একসেট করে বই বিনামূল্যে হাতে তুলে দিতে পেরেছে। ২০০২ সালের একটা ঘটনা জানিয়ে, রংপুর কারমাইকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী আমাকে চিঠি লিখেছে। আমি একজন দরিদ্র ঘরের সন্তান, আমাকে একসেট বই দিবেন। চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে সেখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে এক সেট বই পাঠিয়ে দিয়েছি। কারমাইকেল থেকে আরও দুই তিন জন চিঠি পাঠিয়েছে আমি তাদের ঠিকানা অনুযায়ী পাঠিয়ে দিয়েছি এবং আমি নিজেও যখন মার্কেটিং- এ বিভিন্ন জেলায় যাই তখন স্যারদেরকে আমি নিজের থেকে বলতাম আপনার এলাকায় যদি কোন দরিদ্র ছাত্রছাত্রী থাকে বই কেনার একেবারে সামর্থ্য নেই, তাহলে আপনি আমাদের ঠিকানায় তাদের নাম ঠিকানা পাঠিয়ে দিবেন, আমরা বইগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিবো। এরকম অসংখ্য অসহায় ছাত্রছাত্রীদের পাশে ছিলো দিকদর্শন। বছরে প্রায় ৫০০/৬০০ জন ছাত্রছাত্রীকে দিকদর্শন সহযোগিতা করতো।
এমনকি ইন্টার ফাস্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার ও অনার্স, মাস্টার্সসহ সব বই দিয়েছি কিছু ছাত্র ছাত্রীদের। আবার মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর অনেকেই আবদার করে বলেন সব বই দিয়েছেন একটা নিবন্ধনের বইও দিয়েন। সেটাও পাঠিয়েছি। সে এখন কলেজের শিক্ষক। এরকম অসংখ্য মেধাবীদের সহযোগিতা করেছি।
দিকদর্শন শিক্ষার্থীদের পাশে সবসময়ই ছিল, আগামীতেও থাকবে আশা করি। দিকদর্শন প্রকাশনী শিক্ষার্থী বান্ধব,শিক্ষকবান্ধব ও জনবান্ধব প্রকাশনী। দিকদর্শন ছাত্র ও শিক্ষকের মাঝে প্রকাশক হিসেবে সবসময় থাকবে। সবশেষে আর. সি. পাল বলেন, দিকদর্শন প্রকাশনীসহ তার সহযোগী প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান প্রায় চার সাড়ে চার হাজার বইয়ের প্রকাশক। ব্যবসায়ী হিসেবে কি পেলাম বা পেলাম না সেটা বিষয় নয়, বরং আমার বড় প্রাপ্তির বিষয় হলোএদেশের জ্ঞানী, গুণী শিক্ষকবৃন্দের সাথে ব্যক্তি আমি সবসময়ই থাকি। তাদের সহযোগিতা আর উপদেশ পাচ্ছি। আমি দেশের সরকারি বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছে আর. সি. পাল দাদা নামে পরিচিত। সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসেন আমিও তাদের অনেক শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে। প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও জাতীয় শিক্ষক দিবসে আমরা শিক্ষকদের স্মরণ করে থাকি। মোবাইলে এসএমএস এবং চিঠির মাধ্যমে দিকদর্শন এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়। দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের স্নেহ ভালোবাসা, সম্মান ওশ্রদ্ধাবোধ আমার জন্যে অভিলষিত এবং যেন তা প্রাক্বরাদ্দকৃত।এর চেয়ে আর অধিকপ্রাপ্তির কিছু নেই। এটাই হলো আমার বড় প্রাপ্তি এবং সফলতা।
দিকদর্শন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মাঝে সব সময় ছিল এবং আগামীতেও থাকবে।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,000SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ