মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলছে এখন তুমুল সংঘাত। সেই সংঘাতের আতঙ্ক এবার ছড়িয়ে পড়েছে টেকনাফ সীমান্তে। কিছু দিন মর্টারশেল ও বিস্ফোরণের বিকট শব্দ না থাকলেও আবার গত রবিবার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসে এপারে। সাবরাং ইউনিয়নের পরিষদের সদস্য আব্দুস সালাম জানিয়েছেন, রবিবার রাত দেড়টার দিকে মংডু শহরে নিজেদের দুটি চৌকির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে আরাকান আর্মির সদস্যদের লক্ষ্য করে মর্টার শেল ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিজিপি ও জান্তা বাহিনী। এতে সীমান্তের ওপার থেকে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। এসব শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা টেকনাফ।
এদিকে এই সংঘাতের মধ্যে বাংলাদেশে দলে দলে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। রাখাইন রাজ্যে থেকে সীমান্ত রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। দালালদের মতে প্রতিদিন এই সংখ্যা হাজারের ওপরে। গত দুই মাসে থেকে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে ২০-২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে গোপনে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে এসব দালালচক্র।
এদিকে অনুপ্রবেশের চেষ্টা সময় আটক করে রোহিঙ্গাদের দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়াও অব্যাহত রয়েছে। এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের শতাধিক নৌকাকে আটক করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন কোস্টগার্ড ও বিজিবি। বিজিবির নজরদারি কম এমন পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে দালালরা রোহিঙ্গাদের এ দেশে আনছেন। ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের কৌশলে অনুপ্রবেশ করছে। সেখান থেকে ক্যাম্প ছাড়াও ভাড়া বাসায় তাদের নেওয়া হচ্ছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন দখল নিতে আরাকান আর্মি দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছেন। সে সঙ্গে এ লড়াইয়ে আরও কিছু বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। আরাকান আর্মি গত ৬ মাস যুদ্ধে রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চল ও দেশটির সেনা ও বিজিপি’র ক্যা¤প, চৌকি দখলের পরে মংডু শহর দখল নিতে এখন তীব্র হামলা চালাচ্ছে। অপরদিকে সরকারি বাহিনীও মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পাল্টা হামলা অব্যহত রেখেছে। এ সংঘাতের জেরে মংডু সহ আশপাশের গ্রামে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের প্রাণ হানি ঘটছে। প্রাণ বাঁচাতে নতুন করে ৮ থেকে ১২ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে এক-একটা নৌকা নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের সহায়তায় করছে টেকনাফের স্থানীয় কিছু দালাল চক্র।
মংডু থেকে দালালদের সহায়তায় টেকনাফে আসা রহিম উল্লাহ বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যেই তীব্র যুদ্ধ চলছে। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়। গ্রামের অনেক রোহিঙ্গাকে তারা হত্যা করেছে। মর্টারশেল ও বিমান হামলা চালিয়ে অনেক গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই রাখাইনে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে নৌকা করে নাফনদী পার হয়ে টেকনাফের বড়ইতলী দিয়ে রাতে আঁধারে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। এ কাজে স্থানীয় কিছু লোকজন টাকা নিয়ে সহায়তা করেছে।
মংডু থেকে পালিয়ে আসা আরেকজন সৈয়দ করিম বলেন, মংডু শহরের গ্রামে যখন হামলা করেছে আরাকান আর্মি, তখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে এক সপ্তাহ সীমান্তের কাছে পাহাড়ে অবস্থা করেছি। আরও শত শত মানুষ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল। পরে ক্যা¤েপ পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা স্থানীয় লোকদের সহায়তা নিলে টাকার বিনিময়ে নাফনদী পার হয়ে টেকনাফের হ্নীলা দমদমিয়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়েছি। এখনো মিয়ানমারের সীমান্তে লাখো মানুষ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এরই মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে রয়েছেন। রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য মোটা অংকের টাকা নিয়ে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় কিছু দালাল চক্র। এসব রোহিঙ্গাদের উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ উপর বোঝা হয়ে বসে রয়েছে। এই বোঝা আরও বাড়ছে।
টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সদস্যরা কাজ করছেন। অনেক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ তারা ঠেকিয়েছেন। তবে টেকনাফ উপজেলায় রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের পরে যেসব লোক রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া দিয়েছে বা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে এ কর্মকর্তা জানায়।