আহাদ, হৃদি, আরিয়ান, লামিয়া আক্তার মীম। কারো বয়স ১৫, আবার কারো ১৮ বছরের কাছাকাছি। সবাই যার যার বাবাকে ফিরে পেতে চায়। এদের বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এদের বয়স ছিল ১ বছর থেকে ৩ বছরের মধ্যে। জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর এরা জানতে পেরেছে যে তাদের বাবাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে গুম করেছে। বাবার স্মৃতিও তাদের মনের মধ্যে নেই। বাবার ছবি দেখে এরা শুধু বাবা, ও বাবা বলে ডাকে। কবে আদরের বাবার গলা ধরে ঝুলবে ? বাবার হাত ধরে রাস্তায় কবে হাঁটবে? চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘বাবা ও বাবা তুমি কোথায়? কবে তুমি ফিরবে? দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে। তাহলে তোমাকে কারা ধরে রেখেছে?
বাবার জন্য সন্তান কাঁদছে, সন্তানের জন্য কাঁদছে মা। স্বামীর জন্য স্ত্রী কাঁদছে, ভাইয়ের জন্য ভাই। এদের আপনজন ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হয়ে যায়। আয়নাঘরে বন্দী করে এদেরকে গুম করা হয়েছে। এরকম আয়নাঘর রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের কাছে। এই তিনটি বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এরা গুম হয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের প্রিয়জনরা গতকাল শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফিরে পাবার আকুতিতে তাদের অশ্রæ সিক্ত হয়। সন্তানহারা মা, নিখোঁজ বাবার সন্তান, তুলে নিয়ে যাওয়া ভাইয়ের বোন, স্ত্রীসহ এমন অনেকের কান্নার আওয়াজে শহীদ মিনার এলাকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আসে।
ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ‚্যত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম হওয়া স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ গতকাল আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে।
কাঁদতে কাঁদতে স্বজনহারা মানুষেরা জানতে চান, তাদের প্রিয়জনরা কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন কি না? মেরে ফেলা হলে কোথায় তাঁদের কবর দেওয়া হয়েছে? কোথায় তাদের লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে? তারা বলেন, বাংলাদেশে যেন আর কোনো অজুহাতেই এমন অমানবিক গুমের ঘটনা না ঘটে। একজন মানুষও যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার না হন।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমাদের এখন অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। কল্পনাও করা যাবে না, গত সরকারের অধীনে পুলিশ কতটা অমানবিক ছিলো। আমি ২৩ ঘন্টা ঘুম ছিলাম, ২ মাস জেলে ছিলাম। সেময় এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, সেগুলো লিখলে বিরাট এক বই হয়ে যাবে। ঘুম নিয়ে মায়ের ডাকসহ অনেকেই তালিকা তৈরি করেছে, তার পঁচা নব্বই শতাংশের মতো সঠিক, শতভাগ সঠিক করতে পারবেন কিনা জানি না।
তিনি আরও বলেন, যারা গুম খুনের শিকার তারা একই সাথে খেয়াল করেন, এই জুলাইয়ে কতগুলো মানুষ মারা গেছে। হয়তো হাজারেরও বেশি, আমরা বলতে চাই তাদেরও হত্যার বিচার করতে হবে। যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে, সরকারকে যেতে হবে। আমরা যে মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, সে বাংলাদেশে সকল মানুষকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
গুম হওয়া ইসমাইল হোসেনের মেয়ে আনিকা ইসলাম ইশা বলেন, আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। আমার ছোট ভাই প্রতিদিন আশায় থাকে বাবা ফিরবে। মাঝে মাঝে সে প্রশ্ন করে বাবা কেনো আসে না? আমরা বাবাকে হারিয়ে অসহায়, আমার বাবাকে ফেরত চাই,আমার ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। আমার বাবার কী হয়েছে জানতে চাই।
কাউসার হোসেনের মেয়ে লামিয়া বলেন, ২০১৩ সালের ৪ডিসেম্বর আমার বাবাকে গুম করা হয়েছে। আমি তখন খুব ছোট, আমার বাবাকে আমার মনে নেই। আমার বাবার আদর পাইনি, আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমার বাবাকে আমি ছুঁতে চাই, বাবার আদর কেমন আমি জানতে চাই। আমি এগারো বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার বাবাকে ফেরত চেয়েছি। আমরা একটাই দাবি আমার বাবাকে ফেরত দেয়া হোক।
অনুষ্ঠানের এক কর্ণারে ছেলের ছবি হাতে নিয়ে বসে ছিলেন গুমের শিকার আব্দুল কাদের মাসুমের মা আয়শা বেগম। তিনি বলেন, মাসুম ২০১৩ সালে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ওই সময় তিনি সেনাবাহিনীর কমিশন র্যঙ্কে পরীক্ষা দেন ও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেন। কয়েকদিন পরেই ভাইভা ছিলো মাসুমের। তার মধ্যেই ভাটারা থানাধীন এলাকায় থেকে নিখোঁজ হয় সে। ১২ দিন পরে ১৬ ডিসেম্বর একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে মাসুম। সেই দিনটি ছিলো মাসুমের জন্মদিন। তখন বলেছিল, ‘মা আমি মাসুম, আমি ভালো নেই। আমাকে ওরা মারধর করছে।’ এই কথা বলতে বলতে ফোন কেটে দিয়েছিলো। প্রায় ১১ বছর পার হয়ে যাচ্ছে এখনো মাসুমের কোন খবর নেই। শুধু মাসুম নয় ওই সময় তার সঙ্গে থাকা আল-আমিন, রাসেল, আদনান, সুমনসহ আট জন গুমের শিকার হয়। তাদেরও খোঁজ নেই।
২০১৩ সালে গুম হন সাজেদুল ইসলাম সুমন। তার দুই মেয়ে। তখন বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র, আর ছোট মেয়ের বয়স দেড় বছর। এখন বড় মেয়ে অনার্স ১ম বর্ষে পড়েন আর ছোট মেয়ে আরওয়া ইসলাম ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। হাফসা ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবার কথা কিছুটা মনে আছে। কিন্তু আমার ছোট বোন এখনো বাবার জন্য কাঁেদ। ছবি দেখেই বড় হয়েছে আরওয়া ইসলাম। আমার বাবা বিএনপি করতো বলে তাকে গুম করা হয়েছে। তার কোন হদিস নেই। আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। আমার বাবাকে গুম করার পিছনে যারা জড়িত রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। এটাই আমাদের চাওয়া।’
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের কন্যা মাহফুজা আক্তার বলেন, ১৫ বছর হলো তার বাবা নিখোঁজ। তাদের পরিবারটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমার বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আমি তখন ছোট ছিলাম। এখন বড় হয়েছি। আমার বাবাকে আমি প্রত্যেকদিন স্বপ্নে দেখি। আমরা আর কত কাঁদবো। আমার বাবাকে ১৫ বছর আগে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইন্দিরা রোড এলাকা থেকে আমার বাবাকে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে র্যাবের গাড়িতে তোলা হয়েছিল। যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা বলেছে যে, তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। এখন তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। স্বাধীন এই দেশে কেউ গুম থাকতে পারে না। আমি আমার বাবার সন্ধান চাই।
মায়ের ডাক সংগঠনটির সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। অবশিষ্ট অপশক্তিগুলো এখনো দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলো এখনো পরিবারের কাছে আসছে না।’
অনুষ্ঠানে গুম থেকে ফিরে আসা মাইকেল চামকা বলেন, ‘২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকার কল্যাণপুর থেকে আমাকে সাদাপোশাকধারী সাত জন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। শেখ হাসিনার পতনের পর আমাকে আমার এলাকার একটি জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসে। শেখ হাসিনা এই গুমের মাধ্যমে আমাদের এই ভয় দেখিয়েছিলেন। সরকার ইচ্ছা করলে মাসের পর মাস গুম করে রাখতে পারে। আমরা সব গুম-খুনের ন্যায় বিচার চাই। এখানে যারা কান্না করছে, তাদের কষ্ট আমি বুঝি। দেশে আয়নাঘর নামে যেসব বন্দিশালা আছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। লেখক-কবি-শিল্পীরাসহ সবাই এসবের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে তা বন্ধ হবে না।’
গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বলেন, ‘২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর আমাকে বন্দুক তাক করে গুম করা হয়েছিল। পরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে মিটিং করেছি, কীভাবে তাদের সহায়তা করা যায়। আমরা চাই, এই অন্তর্বতীকালীন সরকার যে কমিশন করেছে, তাদের মাধ্যমে সব গুমের দ্রæত বিচার করতে হবে। পুরো স্টেট মেশিনারিকে আইডেন্টিফাই করতে হবে।’