এবার দুদকের জালে ধরা পড়তে যাচ্ছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সাবেক এই মন্ত্রী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের পুরনো হলেও কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায়নি। অবশেষে তার বস্তা বস্তা টাকা ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুসন্ধান দল গঠন করেছে দুদক। কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে কমিশন সভায় ৫ সদস্যের এই দল গঠন করা হয়েছে। এর প্রধান করা হয়েছে দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে। এর আগে গত মঙ্গলবার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)
দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম জানান, কমিশন সভায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে বস্তায় বস্তায় ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ শিরোনাম একটি অভিযোগ জমা হয়। সেটা অনুসন্ধানের জন্য সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য ছিলেন যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধানের সিন্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে কমিশন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব আবুল ফজল মীর ওরফে বাদল, যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন ও উপসচিব মাহবুবুর রহমান শেখের বিরুদ্ধে একই সিন্ডিকেটে থেকে দুর্নীতি অনিয়মের অংশীদার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে বলে কমিশন কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
দুদকের অপর এক কর্মকর্তা জানান, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই তদন্ত কমিটি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খোঁজ খবর নিবে। কোন কোন কর্মকর্তা তাদের লাভজনক পদে পোস্টিংয়ের জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন সময় ঘুষ ও উপহার দিয়েছেন, সেটিরও একটি তালিকা করা হবে। এই তালিকায় পুলিশের অন্তত অর্ধশত বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার নাম রয়েছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঘুষ হিসেবে বস্তায় ভরে টাকা নিতেন। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর, ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এই টাকা আদায় করা হতো। এ জন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভ‚মিকা পালন করতেন ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মানের জন্য আসাদুজ্জামান খান কামাল ৩০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। ঢাকায় রয়েছে একাধিক বাড়ি ও গাড়ি। এসব সম্পদ তিনি তার ছেলে জ্যোতির নামে করেছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এই সিন্ডিকেটের ড. হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও এই মন্ত্রণালয়ের সকল ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে।
অভিযোগ আরও রয়েছে, বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত নিতো এই চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না।
কামাল-হারুন সিন্ডিকেটের পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা ঃ
তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, সাবেক আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান, শফিকুল ইসলাম, খন্দকার ফারুক হোসেন, সাবেক এডিশনাল আইজিপি ইকবাল বাহার, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজি ওয়াইএম বেলালুর রহমান, সিআইডির সদ্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আব্দুল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, সিআইডির ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম, ডিএমপির সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান, মো. আনিসুর রহমান, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম, ডিআইজি এসএম মোস্তাক আহমেদ, ডিআইজি মো. জামিল হাসান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, ড. একেএম ইকবাল হোসেন, সাজ্জাদুর রহমান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, বিপ্লব কুমার সরকার, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি ইব্রাহিম হোসেন খান, যশোরের সাবেক পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, কক্সবাজারের সাবেক এসপি মাসুদ হোসেন, ডিএমপির মতিঝিলের সাবেক ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান, ঢাকার এসপি মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা, পাবনার এসপি মো. আব্দুল আহাদসহ অন্তত একশ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদায়ন, বদলি ও নিয়োগ নিয়ে ঘুষ গ্রহণ করার অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে।
সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ ঃ
২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্ল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। নিয়োগ পাওয়ার মাস খানেক আগে ড. হারুন অর রশীদের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্ল্যা নজরুল। পরবর্তীতে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে ড. হারুন অর রশীদকে নগদ ২ কোটি টাকা দেন তিনি। এসময় পূর্বের চেকটি ফেরত নিয়ে মোল্ল্যা নজরুল ৩ কোটি টাকার একটি চেক দেন। পরবর্তীতে ওই ৩ কোটি টাকা ড. হারুন বস্তায় ভরে পৌঁছে দেন আসাদুজ্জামান খানের খামারবাড়ি সংলগ্ন মনিপুরের বাসায়।
অভিযোগে বলা হয়, মন্ত্রী পুত্র সাফি মুদ্দাসির খান ওরফে জ্যোতি পুলিশের বদলি ও পদোন্নতির তদবিরের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রন করতেন। জ্যোতি পুলিশের ৪/৫ জন কর্মকর্তার মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে বাবার কাছে চিরকুট পাঠিয়ে দিতেন। একবার এক কর্মকর্তাকে বদলি করতে গিয়ে জ্যোতি ব্যর্থ হন। তার বাবা কামাল তাকে জানান, ড. হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলতে। এ নিয়ে গত জুন মাসে ধানমন্ডির সরকারি বাসায় কলহ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ব্যাপক-ভাঙচুর করেন জ্যোতি।
বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খানকে। এ সংক্রান্ত দুদকে অভিযোগও জমা পড়েছে। ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তার আগে পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ফার্মগেটের মনিপুর পাড়ায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।
ফায়ার সার্ভিস ও কারা অধিদপ্তরে নিয়োগে ঘুষ ঃ
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে মোতাবেক তাদেরকে নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এরমধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। অভিযোগ করা হয়, নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা নিতেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। এছাড়া মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেড থেকে নি¤œস্তরে কর্মচারী নিয়োগে সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর একটি তালিকা দেয়া হত। তালিকায় যাদের নাম থাকত, তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হত।
কারা অধিদপ্তরে কারারক্ষী নিয়োগেও তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে।
দুদকের তদন্ত দলের একজন কর্মকর্তা জানান, অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠদের ঘুষ দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ কমিশনে আগে থেকেই জমা হয়েছে। সেগুলো আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করা হবে।