রাজধানীর মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকার দেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার ভবন সিটি সেন্টারের পেছনে মতিঝিল থানা। দোতালা টিনশেড ভবনের নিচতলায় থানার কার্যক্রম চলে। থানার ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেল ডিউটি অফিসারের রুম। টেবিলে সিভিল ড্রেসে বসে ডিউটি করছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাব-ইন্সপেক্টর মাসুদ খলিফা। দোয়া করবেন যেন আমরা সুন্দরভাবে ডিউটি করতে পারি।’ থানায় পুলিশ কবে থেকে যোগদান করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত ১১ টার দিকে আমরা যোগদান করেছি। আমাদের থানার ৫ জন পুলিশ সদস্য অসুস্থ রয়েছেন। দুই জন ছুটিতে গেছেন। বাকি সবাই থানায় যোগদান করেছেন।’
শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত মতিঝিল থানায় তিনটি জিডি হয়েছে। গাজীপুর এলাকার আব্দুল হাকিম ৩ আগস্ট কমলাপুর এলাকায় তার মোবাইল ফোন হারিয়ে ফেলেন। এই অভিযোগে তিনি জিডি করেন। জিডি নম্বর-২০২। বাকি দুইটি জিডির অভিযোগও মোবাইল ফোন হারানোর।
এভাবেই রাজধানীর ৫০ টি থানার মধ্যে ৩০ টি থানার কার্যক্রম গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে। থানাগুলো হলো কলাবাগান, লালবাগ, চকবাজার, রমনা, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, ডেমরা, গেন্ডারিয়া, মতিঝিল, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর, শেরেবাংলা নগর, হাতিরঝিল, শাহ আলী, কাফরুল, ভাষানটেক, দারুসসালাম, রূপনগর, ক্যান্টনমেন্ট, বনানী, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরখান ও বিমানবন্দর থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শনিবার থেকে মোহাম্মদপুর থানাসহ ৬/৭ টি থানার কার্যক্রম শুরু হবে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে রাজধানীর ৩০ টি থানা ভবন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, মোহাম্মদপুর, বংশাল, কদমতলী, শ্যামপুর ও ডেমরা থানা ভবন সম্পূর্ণরূপে জ্বলে পুড়ে গেছে। থানা ভবনে আসবাবপত্র, সরকারি নথি, ফাইল, অস্ত্রাগার, জানালা-দরজা পুড়ে গেছে। ভবনের দেয়ালের ইট ও পলেস্তার খসে গেছে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পূর্ব ও উত্তরা পশ্চিম থানা ভবন একেবারে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ভবন ব্যবহারের উপযোগী না করতে পারলে কোনোভাবেই থানার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে দেখা যায় আগুনে পুড়ে ছয় তলা ভবন একেবারে কঙ্কালসার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ছয়তলা ভবনে যেতে সামনে পুরাতন দোতালা ভবন। সেটিও পুড়ে গেছে। থানা কম্পাউন্ডে রাখা পুলিশের গাড়ি ও মোটরসাইকেল সবই ভস্মীভ‚ত হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া গাড়ির স্টিলের বডি পড়ে আছে। এই ধ্বংসযজ্ঞ বর্ণনা করার মত নয়।
যাত্রাবাড়ী থানার ভিতরে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। থানার প্রবেশ গেটে সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল রয়েছে। ভিতরে ঢুকে দেখা গেল গাড়ির ধ্বংসযজ্ঞের সামনে ফাঁকা জায়গায় অস্থায়িভাবে একটি টিনশেডের ছাউনি করা হয়েছে। ছাউনির নিচে চেয়ার টেবিল নিয়ে ডিউটি করছে একজন ছাত্র। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আহনাফ। একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সকাল থেকে এলাকাবাসীর অভিযোগগুলো নথিভ‚ক্ত করছি।’
জানতে চাইলে আহনাফ বলেন, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ১২ টি অভিযোগ সরকারি ফাইলে নথিভ‚ক্ত করেছি। ১২ টি অভিযোগের মধ্যে ১১ টি অভিযোগই হল জমি দখল ও নারী নির্যাতন সংক্রান্ত। একটি অভিযোগ করা হয়েছে দোকান ভাংচুর ও লুটপাটে। কদমতলী এলাকার জনৈক রেজাউল অভিযোগ করেছেন, সহিংসতায় মেসার্স কুদ্দুস আয়রন নামে প্রতিষ্ঠানের সব জিনিসপত্র লুট হয়েছে।
যাত্রাবাড়ী থানায় আনসারের ৮ জন সদস্য ডিউটি করছেন। এই আট সদস্যের টিমের প্রধান হাবিলদার অহিদুল ইসলাম বলেন, যাত্রাবাড়ী থানার সবকিছু পুড়ে শেষ। এ অবস্থায় আমরা থানার নিরাপত্তা দিচ্ছি। আনসার সদস্য সিপাহী সাকিবও একই কথা জানালেন।
টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেটের পাশে পুলিশের দশ তলা ভবনের ৫ম তলায় ওয়ারী থানার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গতকাল সকালে ওই ভবনে প্রবেশ করে দেখা গেল, ভবনের বেজমেন্টে রাখা পুলিশের সকল গাড়ি ও মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। দোতালায় পুলিশের ব্যারাকের সকল আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। ৫ম তলা থেকে দশম তলা পর্যন্ত ওয়ারী থানা, থানার কনস্টেবলদের ব্যারাক, জরুরী সেবা ৯৯৯-এর প্রশিক্ষণ সেন্টারসহ আরো বেশ কয়েকটি পুলিশের অফিসের সব আসবাবপত্র লুট হয়ে গেছে।
ওয়ারী থানার ওসি জানে আলম মুন্সী বলেন, সবকিছু লুট হয়ে গেছে। কনস্টেবলদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, থানায় রাখা পুলিশের অস্ত্রসহ সাধারণ মানুষের জমা দেয়া লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র সবই লুট করেছে। থানায় রাখা মামলার আলামত হিসাবে গাড়ি ও মোটরসাইকেল প্রায় ২শ’টি ছিল। এগুলো জ্বালিয়ে না দিয়ে লুট করে নিয়ে গেছে। এ অবস্থার মধ্যে হয়তো আমরা শনিবার থেকে থানার কার্যক্রম শুরু করতে পারব।
লালবাগ থানার ওসি খন্দকার হেলাল উদ্দিন বলেন, দুর্বৃত্তরা থানা ভবন ভাংচুর করে সকল আসবাবপত্র নিয়ে গেছে। এমনকি কনস্টেবলদের ঘুমানোর জন্য স্টিলের চৌকি, চেয়ার, টেবিল-সবকিছু নিয়ে গেছে। থানার মূল্যবান কাগজপত্র, মামলার নথিপত্র কিছুই নেই। তারপরও শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শনিবার থেকে জিডি বা মামলা গ্রহণ করা হবে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, থানা ভবন জ্বালিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বৃহস্পতিবার থেকে থানা ভবন পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে আমরা চেয়ার টেবিল বসিয়ে কাজ শুরু করেছি। তবে জিডি গ্রহণ করা হবে শনিবার থেকে। আমরা থানার অফিসিয়াল কাজ করছি। অপারেশন্সের কাজ শুরু হয়নি।