spot_img

বাংলাদেশ একটি পরিবার, একসঙ্গে চলতে চাই, তরুণরা মনের মতো দেশ গড়বে শপথের আগে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে ড. ইউনূস

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তরুণদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করল। এই স্বাধীনতাটা আমাদের রক্ষা করতে হবে। দেশ আজ তরুণ সমাজের হাতে। তারাই যেহেতু দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করেছ, তারা এখন মনের মতো করে তাদের দেশটা গড়বে। তাদেরকে দেখে দুনিয়া শিখবে- তরুণ সমাজ কীভাবে একটা দেশ গড়ে তুলতে পারে। তিনি বলেন, গোটা বাংলাদেশটাই আমাদের পরিবার, এই পরিবারের সকলকে নিয়ে একসঙ্গে অগ্রসর হতে চাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের আগে দুপরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে দেশে ফিরে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালে ড. ইউনূসকে ফুল দিয়ে উষ্ণ শুভেচ্ছা ও অভ্যর্থনা জানানো হয়। তাকে স্বাগত জানান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর এলাকায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এসময় উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরের বাইরে অনেককেই হাতে ব্যানার-প্ল্যাকার্ড, ফুল নিয়ে ড. ইউনূসকে বরণ করতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাসায় যান ড. ইউনূস।
‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা প্রথম কাজ, সবার ওপর আক্রমণ ষড়যন্ত্রের অংশ’
দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আসার পথে শুনলাম- এখানে আইন-শৃঙ্খলার ব্যাঘাত হচ্ছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে, ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, সম্পদ নষ্ট করছে, অফিস-আদালতে আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-আহমদিয়া সবার ওপর আক্রমণ করছে; এগুলো হলো ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। এগুলো আমাদের বিষয় না। আমাদের কাজ হলো, এদের রক্ষা, সবাইকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করা, একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
তিনি বলেন, যে বিশৃঙ্খলা-সহিংসতা এগুলো হলো অগ্রগতির বড় শত্রæ। আমাদের যে যাত্রা শুরু হলো, সেই যাত্রার শত্রæ। এই শত্রæকে যাতে রোধ করা যায়, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে হোক কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দিয়ে হোক; তাদের বোঝাতে হবে। মেরে-পিটিয়ে, এটা ঠিক না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ঠিক না। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও এমন হতে হবে, যেন তাদের হাতে সোপর্দ করেও আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি যে এটার একটা বিহীত হবে। এমন না যে, তাদের হাতে তুলে দিলাম, তারা দুটা টাকার বিনিময়ে আবার ছেড়ে দিল। আমাদের সেই আস্থাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। সবাইকে রক্ষা করা আমাদের কাজ। প্রতিটা মানুষ আমাদের ভাই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা আমাদের প্রথম কাজ। দেশবাসী যদি আমার ওপরে বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করে বলতে পারি- দেশের কোনো জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব যা কিছু আছে, সেটা সরিয়ে ফেলতে চাই। যারা বিপথে গেছে, তাদের পথে আনতে চাই; যাতে করে একসঙ্গে আমরা কাজ করতে পারি।
‘আবু সাঈদ অবিশ্বাস্য সাহসী যুবক’
গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে স্মরণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, আজকে আমার আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে। যে আবু সাঈদের ছবি প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য একজন সাহসী যুবক। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে আর কোনো তরুণ-তরুণী হার মানেনি। তারা বুক পেতে গুলি খেতে ভয় করেনি। সামনে এগিয়ে গেছে এবং বলেছে- যত গুলি মারো, মারতে পারো; আমরা আছি। যার ফলে, সারা বাংলাদেশ জুড়ে এ আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করল। এই স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে। তরুণ সমাজ এটা সম্ভব করেছে। তাদের প্রতি আমরা সমস্ত কৃতজ্ঞতা জানাই। আজ আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল তরুণেরা সেটাকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর এই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন।
ড. ইউনূস বলেন, যে বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল তরুণেরা সেটাকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তরুণরাই বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে, নতুন করে পুনর্জন্ম দিয়েছে। তরুণদের মধ্যে যে সৃজনশীলতা রয়েছে, সেটাকে কাজে লাগাতে পারবে। তরুণদের সঙ্গে অন্যান্য সময়ের আলাপের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তাদের আমি এমনিই বারবার পরামর্শ দেই যে পুরনোদের বাদ দাও। তাদের পুরনো চিন্তা দিয়ে আমাদের মুক্তি হবে না কোনোদিন। সারা দুনিয়ার মধ্যেই এটা হবে না। শুধু বাংলাদেশের কথা না, সারা দুনিয়ার কথাই বলছি। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, যে সৃজনশীলতা আছে; সেটাকেও কাজে লাগাতে হবে। এটা শুধু বই-খাতাতে লেখার জিনিস না। প্রকাশ করার জিনিস, স্থাপন করার জিনিস।
‘দমনপীড়নের যন্ত্র সরকার হতে পারে না’
তিনি বলেন, সরকার বলে একটা জিনিস আছে। কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। সরকার হয়ে উঠেছিল দমনপীড়নের একটি যন্ত্র। যেখানে সুযোগ পায়, সেখানেই কষ্ট দেওয়া সকল স্তরে। এটা আসলে সরকার হতে পারে না। সরকারকে দেখে মানুষ উৎফুল্ল হবে। সরকার মানুষকে রক্ষা করবে। নতুন সরকার মানুষের আস্থাভাজন হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
নিজের সরকার ভাবনা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে। যে আমাকে সাহায্য করবে, আমাকে রক্ষা করবে, আমার সরকার আমার জন্য দাঁড়াবে। সরকার তার (জনগণ) জন্য দাঁড়ায়নি কখনও। নতুন সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নতুন সরকার মানুষকে রক্ষা করবে, মানুষের আস্থাভাজন হবে। কেউ জোর করে তাকে বলাবে না যে, ভালো হয়েছে। সে নিজে নিজে বিশ্বাস করবে, সরকারি লোক দেখলে বলবে- সে আমার লোক, আমাকে রক্ষা করার লোক। সেই আস্থাটা মানুষের মনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানুষও যোগ দেবে এটার মধ্যে। মানুষ এখন পিছিয়ে থাকে, মনে করে কীসের মধ্যে আমাদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,000SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ