মানুষ নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। সারাদেশেই পাড়া-মহল্লায় বাসিন্দারা নিজেরাই রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেন। এর মধ্যেই ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে। কয়েক এলাকায় এলাকাবাসী নিজেরাই ডাকাত ধরে সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করেছে। এদিকে থানাগুলোতে ফিরতে শুরু করেছে পুলিশ সদস্যরা। তবে খুব সহসাই স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার সুযোগ কম। কারণ অধিকাংশ থানাতেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়িগুলোও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন থানায় কিছু কিছু পুলিশ সদস্য কাজে আসছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মইনুল হাসান বলেন, পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরতে শুরু করেছে। আমি কয়েকজন ওসিকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম। তাদের কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি। যেসব থানা আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ওই থানাগুলো পরিস্কার করে স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু করা হবে। এছাড়া যে থানাগুলোতে হামলা হয়নি, সেগুলোতে পুরোদমে কাজ শুরু হচ্ছে। শুক্রবার বা শনিবার থেকেই থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার চেষ্টা করছি। পুলিশ কাজ শুরু করতে পারলে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক আছে, সেগুলো আর থাকবে না। আমরা মানুষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি।
মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটির ১০ নম্বর রোডের বাসিন্দা ও একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধান অপলক হাসান সজীব বলেন, বুধবার রাত ২টা ১০ মিনিটের দিকে ৭-৮ জন এসে আমাদের বাড়ির গেট ভাঙতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের সিকিউরিটি গার্ড সচেতন থাকায় তিনি সবাইকে দ্রæত খবর দেন। ফলে আমরা সবাই নেমে আসলে তারা পালিয়ে যায়। এ সময় আশপাশের বাড়ির বাসিন্দারাও নেমে আসেন। যারা এসেছিল তাদের মধ্যে দুই তিনজন ছিল মধ্যবয়সী। আর অধিকাংশ বয়সে তরুন। তাদের দেখে মনে হয়েছে কোন বস্তি থেকে এসেছে। আসলেই আমরা খুবই আতঙ্কের মধ্যে আছি।
বুধবার গভীর রাতে কাজীপাড়ার বাঁশপট্টি এলাকায় একাধিক বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ওই দিন গভীর রাতে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে ও আদাবরে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। উত্তরা ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর সেক্টরে ডাকাতি হচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মসজিদের মাইক থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়। উত্তরা এলাকা থেকে ১১ জন ডাকাতকে ধরে এলাকাবাসী সেনাবাহিনীর কাছে সোপর্দ করেছে। ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার ইসিবি চত্বরের পাশে অনলাইন গ্রæপের জমি, ভবন দখল নিয়ে দুই গ্রæপের মধ্যে বুধবার রাতে গোলাগুলি হয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানের আহŸান জানিয়েছিলেন। তার আহŸানে সাড়া দিয়ে পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে ফিরছেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেসব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তাদেরকে আসার পথে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষার্থী এবং আপামর জনসাধারণ যাতে পুলিশ সদস্যরা নিরাপদে কর্মস্থলে আসতে পারেন সেজন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন।
রাজধানীর শের-ই বাংলা নগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আহাদ আলী বলেন, আমার থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে শুধুই ধ্বংসস্তুপ। বসে কাজ করার কোন সুযোগ নেই। আজকে সবাই এসেছিল, আমি তাদের চলে যেতে বলেছি। থানার অবস্থা আমি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। আশা করছি, আগামীকাল শুক্রবার থেকে স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু করতে পারব। তবে এলাকায় টহলসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করতে সময় লাগবে। পুলিশের গাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে থানায় বসার মতো একটা জায়গা তৈরী করা হবে। এরপরই আমরা কার্যক্রম শুরু করব।
গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাযহার হোসেন বলেন, আমরা কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছি। পুলিশ সদস্যরা আসতে শুরু করেছে। কার্যক্রম শুরু করতে আমাদের আরেকটু সময় লাগবে।
এদিকে রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা মার্কেটের সামনে একটি আবাসিক বহুতল ভবনের নিচতলা ও দোতালায় কলাবাগান থানার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বৃহস্পতিবার বিকালে এই থানায় ঢুকতে দেখা গেল, বহুতল ভবনের গ্রিলের গেট বন্ধ। বাহির থেকে ইশারা দেয়ার পর একজন আনসার সদস্য এসে গেট টেনে খুলে দিলেন। থানার কার্যক্রম চালু হয়েছে কি-না জানতে চাইলে আনসার সদস্য জাহিদুল ইসলাম বলেন, “বুধবার আমরা কলাবাগান থানায় এসেছি। আমরা নিরাপত্তা দিচ্ছি। কিন্তু কোনো পুলিশ সদস্য এখনও আসেননি।” আট জন আনসার সদস্য কলাবাগান থানায় ডিউটি করছেন। এই আট সদস্যের দলের প্রধান নায়েক আব্দুর রহিম বলেন, “কলাবাগান থানায় কোনো ভাংচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। থানার সরকারি জিনিসপত্র অক্ষত আছে। তবে পুলিশ সদস্য আসেনি বলে কার্যক্রম শুরু হয়নি। আমরা থানার নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি।”
এদিকে গতকাল বিকেলে রাজারবাগে পুলিশ কনস্টেবলরা মিছিল করেছেন। তারা সহকর্মী হত্যার বিচার দাবি করেছেন। পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবির তালিকা পাওয়া গেছে। ১১ দফা দাবির প্রথমটিতে বলা হয়েছে, ছাত্র আন্দোলনে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করতে হবে। যেসব পুলিশ নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক ক্ষতিপূরণ, আজীবন রেশন-পেনশন দেয়ার কথা রয়েছে দ্বিতীয় দাবিতে। এসআই ও সার্জেন্ট নিয়োগ পিএসসির অধীনে এবং কনস্টেবল নিয়োগ শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে হতে হবে বলে দাবি করা হয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী পুলিশের জন্য কর্মঘণ্টা কমিয়ে আট ঘণ্টায় আনা, ছুটি ও ওভারটাইম নিশ্চিত করার দাবিও করা হয়েছে। পুলিশকে যেন কোন রাজনৈতিক সরকার তাদের কর্মী হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, তেমন ব্যবস্থা তৈরি করা। সে জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করার দাবিও রয়েছে।
ধ্বংসস্তুপ চট্টগ্রামের থানাগুলো : চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার থানাগুলোতে এখনো স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে এলাকাবাসী রাত জেগে ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছেন। ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় রাস্তায় যান চলাচল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, যে সকল থানা ক্ষতিগ্রস্ত ও ধবংসস্তুুপে পরিণত হয়েছে সেগুলো একসাথে সক্রিয় করার জন্য এ মুহুর্তে জনবল নেই। অপরাধ ও অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে থানায় অভিযোগ করতে গেলে সেখানে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ বাহিনীর মনোবল শক্ত করে তাদেরকে কর্মস্থলে ফেরানোর ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি। নগরীর কোনো থানাতেই গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্বাভাবিক পুলিশিং কার্যক্রম শুরু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম।
বরিশালে পুলিশ সদসদের বিক্ষোভ : বরিশাল অফিস জানায়, রাজনৈতিক ভাবে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার না করা, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের পছন্দমতো থানায় পদায়ন বন্ধসহ বিভিন্ন দাবীতে বিক্ষোভ করেছে পুলিশ সদস্যরা। গতকাল বিকেলে বরিশাল জেলা পুলিশ লাইনসে সাধারণ পুলিশ সদস্যদের সাথে উর্ধ্বতনরাও উপস্থিত ছিলেন। তারা দাবী জানিয়ে বলেন, একটি সু-শৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হিসেবে এবং সরকারি আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুবই ক্ষীণ। গতকাল সন্ধ্যায় বরিশাল বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতে গোনা কয়েকজন পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত হলেও তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা জানান, তারা থানায় অবস্থান করছেন তবে বাহিরে কোনো কাজে যাচ্ছেন।
খুলনায় পুলিশ সদস্যরা কাজে ফেরেনি : খুলনা অফিস জানায়, খুলনায় মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। জনরোষের ভয়ে গতকাল বৃহস্পতিবারও পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেনি। এদিকে, পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন না করার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চোর-ডাকাতের আতঙ্ক বিরাজ করছে। চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে নগরীরসহ গ্রামাঞ্চলের পাড়া-মহল্লায় মানুষ রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে পুলিশদের বিক্ষোভ : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, স্বাধীন কমিশন গঠন, পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করে দলীয় প্রভাব মুক্ত জনগনের কল্যাণে নিয়োজিত, যে রংয়ের ইউনিফর্ম পরিধান করে কলংকিত হলাম সেই পোষাকের পরিবর্তন করে কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত একই ড্রেসকোড, সকল পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা, যেসব পুলিশ অফিসারের কারনে পুলিশ সদস্য ও ছাত্র-জনতার মৃত্যু হয়েছে সে সকল পুলিশ অফিসার গ্রেপ্তার পুর্বক বিচারের দাবীসহ ১১ দফা দাবীতে বিক্ষোভ কর্মসুচী পালন করেছে পুলিশ সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকালে সিরাজগঞ্জ পুলিশ লাইনে জেলায় কর্মরত এসআই, এ.এসআই ও কনস্টেবলরা এ বিক্ষোভ কর্মসুচী পালন করেন।