শান্তিতে নোবেলজয়ী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনের দরবার হলে শপথ নিয়েছেন। তাকে প্রথমে সংবিধান রক্ষার ও পরে গোপনীয়তা রক্ষার শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে শপথ বইয়ে সই করেন ড. ইউনূস। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের তিনদিনের মাথায় অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলো।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ১৬ জন। তাদের মধ্যে তিনজন রাজধানীর বাইরে অবস্থান করায় অবশিষ্ট ১৩ জন গতকাল শপথ নেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই অন্যতম সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রয়েছেন। তারা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ১৩ জন উপদেষ্টাকেও শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি। রাত ৯টা ২১ মিনিটের দিকে এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। শপথ শুরুর আগে ছাত্রদের অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে বঙ্গভবনে উপস্থিত সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারের অন্য ১৪ জন উপদেষ্টা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রাক্তন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নির্বাচন পর্যবেক্ষক শারমিন মুর্শিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকী আজম, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, চিকিৎসক বিধান রঞ্জন, ইসলামি চিন্তাবিদ আ ফ ম খালিদ হাসান, উন্নয়নকর্মী ফরিদা আখতার ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান বেগম। বিধান রঞ্জন, সুপ্রদীপ চাকমা ও ফারুকী আজম ঢাকার বাইরে থাকায় গতকাল শপথ নিতে পারেননি। তবে উপদেষ্টা হিসেবে তাদের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তীতে তারা শপথ নেবেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
শপথের আগে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সদস্যদের প্রটোকলে রাত ৮টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন ড. ইউনূস। তিনি বঙ্গভবনে এলে বাইরে অপেক্ষমাণ জনতা তাকে অভিবাদন জানান ও স্লোগান দেন।
গতকাল দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান ড. ইউনূস। সেখানে তাকে স্বাগত জানান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমান ও নৌ বাহিনীন প্রধান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। অলিম্পিক কমিটির আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসেবে প্যারিসে গিয়েছিলেন ড. ইউনূস। সেখানে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন, তার একটি ছোট অস্ত্রোপচার হয়েছে।
ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে প্রথম বক্তৃতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাই হবে আমার প্রথম কাজ। কারও ওপর কোনো হামলা যেন না হয়। দেশবাসী যদি আমার ওপরে বিশ্বাস রাখেন, ভরসা রাখেন, তাহলে দেশের কোনো জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশ পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত মঙ্গলবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। ওইদিন রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন ড. ইউনূস।
শপথ অনুষ্ঠানে গেলেন যারা
শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি-জাপাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাগণ এবং পেশাজীবীরা অংশ নেন। তবে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র ১৪ দলের কেউ ছিলেন না। শপথ অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০০ জন অতিথি যোগ দেন।
দরবার হলে প্রথম সারির মাঝখানে বসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার বাম দিকে বসেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, এরপর বসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এরপর অন্তবর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারা বসেন।
প্রধান উপদেষ্টার ডান দিকে বসেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান হাসান মাহমুদ খাঁন। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও মহাসচিব আহসান হাবীব লিংকন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ।
দ্বিতীয় সারিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, আবদুলাহ আল নোমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, জয়নুল আবেদীন ফারুক, শামসুজ্জামান দুদু, আমানউলাহ আমান, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বসতে দেখা যায়।
একই সারিতে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, বাসদের খালেকুজ্জামান, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
দ্বিতীয় সারিতে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানকে দেখা গেছে। হুইল চেয়ারে করে এ সারিতে বসেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। এরপর তৃতীয় সারিতে বসেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। শপথ অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দেখা যায়নি। তার আসনটি শূন্য ছিল। অপরদিকে, বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বিএনপির নেতাকর্মীদের তোপের মুখে শপথ অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারেননি। তবে, দলটির মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
শপথ নিয়েই আন্দোলনে আহতদের দেখতে ঢামেকে ড. ইউনূস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘর্ষে আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গেছেন ড. ইউনূস। গতকাল রাত সাড়ে ১০টায় তিনি সেখানে যান। তিনি হাসপাতালে আহতদের সার্বিক খোঁজখবর নেন। প্রায় ১৫ মিনিট তিনি সেখানে অবস্থান করেন। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন সরকারের উপদেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদসহ কয়েক উপদেষ্টা।
‘যমুনা’য় উঠবেন প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজধানীর হেয়ার রোডে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘যমুনা’য় উঠবেন। সেখানে তাকে বরণ করে নিতে চলছে প্রস্তুতি। এর অংশ হিসেবে ঝাড়পোছ চলছে। এটি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
‘যমুনা’ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ধোয়ামোছার কাজ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সিটি করপোরেশনসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারীরা। ভবনটির প্রধান গেটে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী, আনসার ব্যাটালিয়ন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের।