তুমুল গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত হত্যা, সমস্ত অবিচারের বিচার আমরা করব। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখেন। আপনারা আশাহত হবেন না।’
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর গতকাল সোমবার বিকেল চারটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগের দ্বিতীয় দিন ঢাকামুখী লং মার্চ কর্মস‚চিতে ছাত্র-জনতার রাজপথে নেমে আসার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এ সময় তিনি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরেন। সেনাপ্রধান ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা ইনটেরিম গর্ভমেন্ট ফর্ম করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করব। আপনারা একটু ধৈয্য ধরেন, আমাদের কিছু সময় দেন। ইনশাহআল্লাহ, আমরা সবাই মিলে সমস্ত সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবো। আপনারা আর এ সংঘাতের পথে যাবেন না। শান্তি শৃঙ্খলা পথে ফিরে আসুন।’
সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক সফল হওয়ার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আপনারা সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন যত দাবি আছে প‚রণ হবে। আপনারা সব ধরনের সহযোগিতা করেন। আমি সমস্ত দায়িত্ব নিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ সব দাবি প‚রণ করব। শান্তি ফিরিয়ে আনব। আপনারা সহযোগিতা করেন। দেশে একটা শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসব।’ তিনি বলেন, প্রধান দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা প্রস্তাব রেখেছি। সবাই রাজি হয়েছেন। আমরা সুন্দর আলোচনা করেছি। সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি-একটা ইনটেরিম গর্ভমেন্ট ফর্ম করব এবং ইন্টটেরিম গর্ভমেন্টের মাধ্যমে এ দেশের সমস্ত কার্যকলাপ চলবে। আমরা এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাব। এ ইনটেরিম গর্ভমেন্টের ব্যাপারে উনার সাথে আলাপ আলোচনা করে দেশ পরিচালনা করব।’
ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘একসাথে কাজ করলে আমরা সুন্দর পরিস্থিতির দিকে যাব। মারামারি করে আর কিছু পাব না। ধ্বংসযজ্ঞ, অরাজকতা থেকে বিরত হন। সবাই মিলে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে যাব। প্রতিটি হত্যার বিচার হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জামায়াতের আমীর, বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃবৃন্দ ছিলেন। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আসিফ নজরুল ছিলেন। তারা সুন্দর একটি বার্তা দিয়েছেন। আমরা সুন্দর বন্দোবস্ত করেছি। সুন্দর একটা অন্তবর্তী সরকার গঠন করে সরকার পরিচালনা করব।’ ছাত্র-জনতাকে শান্ত হওয়ার আহŸান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আর সংঘাতের পথে যাবেন না। আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। সম্পদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আপনারা আমাদের সাহায্য করেন।’
বক্তব্য দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, ‘ বৈঠকে আওয়ামী লীগের কেউ ছিল না। এটি বিশেষ পরিস্থিতি, আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব। আপনারা সাহায্য করেন।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি যদি শান্ত হয়ে যায়, তাহলে তো কারফিউয়ের প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনী কোনো গোলাগুলি করবে না। পুলিশ গোলাগুলি করবে না। আমি আদেশ দিচ্ছি। আমরা আজকে রাতের মধ্যেই একটু সুন্দর সমাধানের দিকে যাব।’ সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমার সাথে সহযোগিতা করেন। দয়া করে আর এ ভাংচুর, হত্যা, মারামারি, সংঘর্ষ এগুলো থেকে বিরত হোন। আমি নিশ্চিত, আপনারা যদি আমার কথা মত চলেন, আমাদের সাথে একসাথে কাজ করি; নিসন্দেহে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশের দিকে অগ্রসর হতে পারব।’ রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি বিশিষ্টজনের সঙ্গে ফলপ্রসু আলোচনার কথা তুলে ধরে সেনাপ্রধান সবাইকে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহŸান জানিয়ে বলেন, সহিংসতা থেকে বিরত হন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। অর্থ সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। লোকজন মারা যাচ্ছে। এগুলো থেকে আপনারা বিরত হোন, আমাদের সাহায্য করেন। আমি সমস্ত দায়িত্ব নিচ্ছি। আপনারা আমাকে সাহায্য করেন।’ প্রশ্নোত্তরে অন্তর্র্বতী সরকারের সদস্য সংখ্যা কত হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও এটা নয়, খুব আর্লি স্টেজ। আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা করব।’
সেনাপ্রধান জানান, আলোচনায় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাললয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জোনায়েদ সাকি উপস্থিত ছিলেন। এদের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজ চালিয়ে যাবে। সবার দায়িত্ব, ছাত্র, রাজনীতিক কর্মীদের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা। আপনার মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করেন। তাহলে আমরা এ পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ আসতে পারব।’ কারফিউ কবে তোলা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি শান্ত হলে কারফিউর নেই। জরুরি অবস্থার প্রয়োজন নেই। কোনো গোলাগুলির প্রয়োজন নেই। আমি আশা করছি যে, আমার এ বক্তব্যের পরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আমরা একটা সুন্দর পরিবেশের দিকে যাচ্ছি।’ এ সময় নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানসহ সেনাবাহিনী শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র-শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসবেন সেনাপ্রধান: সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অতি শিগগির ছাত্র-শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসবেন। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।