রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও মেট্রোরেলের মিরপুর ও কাজীপাড়া রেলস্টেশন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান (৩১)সহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতারকৃত অপর তিন জন হলেন সজল মিয়া (২৪), আল ফয়সাল রকি (২৭) ও আরিফুল ইসলাম (৩০)। সোমবার রাতে রাজধানীর আফতাবনগর ও মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে শর্টগানের গুলির দুইটি খোসা, ২ টি ল্যাবটপ, ৩ টি সিপিইউ, ১ টি হার্ডডিস্ক, ১ টি মর্ডেম, ১ টি এটিএম কার্ড, ৪ টি মোবাইল ফোন ও ১১ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃতদের মোবাইল ফোন থেকে নিজেদের করা ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা হয়। ওই সব ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার দিন শুক্রবার, ১৯ জুলাই দুপুরের পর গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ন সদস্য সচিব তারেক রহমান রামপুরা ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর উল্লাস প্রকাশ করে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মোবাইল ফোনে সেলফি ভিডিও করেন। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন। এরপর তিনি পাশেই বিটিভির ৩ নম্বর গেট একদল নাশকতাককারী ভেঙ্গে ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে। তারেক রহমান বিটিভির অভ্যর্থনা কক্ষের সামনে গিয়ে ভাংচুর করতে থাকা অন্যজনকে আরো বেশি করে ভাংচুর করে আগুন ধরিয়ে দিতে বলেন। গ্রেফতারকৃতদের সাথে দেশের বাইরে অবস্থান করা রাষ্ট্র বিরোধী একটি শক্তির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। তবে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ থাকায় তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল যে অগ্নিসংযোগের ভিডিও সব একত্র করে পরবর্তী বৈঠকে উপস্থাপন করতে হবে।
গতকাল কাওরানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতারকৃতদের অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের তথ্য উপস্থাপন করেন আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস। সংবাদ সম্মেলনের পর গণমাধ্যমের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন র্যাব মহাপরিচালক ব্যারিষ্টার হারুন অর রশীদ।
সংবাদ সম্মেলনে লে.কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, গ্রেফতারকৃত তারেক রহমান কুমিল্লার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকায় মৌসুমী ফলের ব্যবসা করেন। ২০১৮ সালে সাধারণ ছাত্র পরিষদ গঠিত হলে তাকে যুগ্ম সদস্য সচিব নির্বাচিত করা হয়। তিনি যুব অধিকার পরিষদের সাথেও যুক্ত ছিল। পরে গণঅধিকার পরিষদ গঠন হলে তাকে সংগঠনটির যুগ্ম সদস্য সচিব পদ দেয়া হয়। ২০২১ সালে গণঅধিকার পরিষদ দুই ভাগে বিভক্ত হলে তিনি একটি অংশের সাথে যুক্ত হয়ে সরকার বিরোধী প্রচারণা ও রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে থাকেন। চলতি বছরের জুন মাসে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে তিনি রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন ইউটিউব ও ফেসবুক পেজে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিভিন্ন গুজব পরিচালনা করা শুরু করেন। রাষ্ট্র বিরোধী গোষ্ঠীর নির্দেশনায় তিনি সরকার পতনের জন্য দুস্কৃতিকারীদের সাথে একত্রিত হয়ে বিটিভিসহ রামপুরায় পুলিশের স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের নেতৃত্ব দেন।
র্যাবের মিডিয়া শাখার পরিচালক লে.কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আরিফুল দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে লালমাটিয়ার একটি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান দেন। দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেক রহমানের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরিফ বিভিন্ন সময় সরকার বিরোধী প্রচারণা শুরু করেন। বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই আরিফ প্রথমে মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে ভাংচুর করেন। পরদিন শুক্রবার দুপুরে কাজীপাড়া স্টেশনে অগ্নিসংযোগ করেন। এরপর তিনি মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরে নেতৃত্ব দেন।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সজল মিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি অনলাইনে মধু বিক্রির ব্যবসা করেন। ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৯ সালে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ঘটনার দিন শুক্রবার দুপুরে তারেকের সঙ্গে রামপুরায় বিটিভি ভবন ও পুলিশের স্থাপনায় অগ্নিসংযোগে অংশ নেন। তাদের সঙ্গে ফয়সালও অংশ নেন। গ্রেফতারকৃত ফয়সাল মহানগর প্রজেক্টের একটি কলেজের ডিগ্রী তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে ফয়সাল ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি পদ পান।
হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়নি ঃ
র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব মহাপরিচালক ব্যারিষ্টার হারুন অর রশীদ বলেন, গত শুক্রবার কোটা সংস্কার আন্দোলনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করে। তারা প্রধান সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধাগ্রস্থ করে। র্যাব তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার দিয়ে নন নাথাল উইপেন (প্রাণঘাতি নয়) ব্যবহার করা হয়। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করা হয়। হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি করা হয়নি। আমাদের সকল অপারেশন ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। এছাড়া বাড্ডা এলাকার একটি বহুতল ভবনের ছাদে আটকে পড়া পুলিশের ৬০ জন সদস্যকে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, এই নাশকতার সঙ্গে বাইরের একটি শক্তির ইন্ধন রয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সহিংসতা দমন করতে আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব জানতে পেরেছে যে কোটা বিরোধী আন্দোলনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নাশকতাকারী এই চক্রটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। আমরা এরই ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়েছি। যারা ধ্বংসযজ্ঞের সাথে জড়িত তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।