প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস মানুষকে শক্তি দেয়। কেউ সমালোচনা করলেই ভীত হয়ে যেতে হবে, আমি এটা বিশ্বাস করি না। শিক্ষার্থীদের বলবো, সবসময় এটাই চিন্তা করতে হবে। কে কী বললো, তার জন্য চোখের পানি ফেলে মুখ লুকাতে হবে তা না। নিজের বিশ্বাস থেকে শিখতে হবে। তাহলে এ দেশকে তোমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।’
গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের (পিএমইএটি) অধীনে অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। মাধ্যমিক থেকে স্নাতক (পাস) এবং সমমানের অস্বচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও টিউশন ফি বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্টাইপেন্ড ও টিউশন ফি’র টাকা ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরাসরি সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে যাবে। তিনি বলেন, তারা মেধাবী অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের তাদের মেধাকে দেশ ও মানব কল্যাণের কাজে লাগাতে তাদের প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট (পিএমইএটি) গঠন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘দারিদ্র্য কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না’ উক্তির স্মরণ করেন। শিক্ষাবৃত্তির জন্য অনুদান দিতে বিত্তবানদের প্রতি আহŸান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক বিত্তবান আছে। কিছু লোকের তো বেশ টাকা-পয়সা হয়ে গেছে। বিত্তবানরা যদি এই ট্রাস্ট ফান্ডে অনুদান দেয় তাহলে আমরা আরো বেশি শিক্ষার্থীদেরকে সহায়তা করতে পারবো।’ স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করার জন্য অনেক চক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। কিছু লোকের সবসময় কোনও কিছু ভালো লাগে না। আর ভালো হতেও দিতে চায় না। তাদের পাত্তা না দিলেও চলবে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, এখন স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্টাইপেন্ড এবং টিউশন ফি বাবদ অর্থ বিতরণ করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।’ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক এবং সমমানের ৬৪ লক্ষ ৭০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে সর্বমোট ২ হাজার ২শ’ ৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতা-২০২৪ এর ১৫ জন শিক্ষার্থী এবং ২১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০২৩ সালের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্কলার অ্যাওয়ার্ড’ বিতরণ করেন। ‘বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্ত ১৫ শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই দুই লক্ষ টাকা ও একটি সনদপত্র পেয়েছেন। এছাড়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্কলার অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্ত ২১ শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই একটি সনদপত্র ও তিন লক্ষ টাকা করে পেয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বেগম শামসুন নাহার ও শিক্ষা সচিব সোলেমান খান অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। হাজারীবাগ গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের অস্টম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান মালিহা; দিনাজপুরের আমেনা-বাকি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আতিফা রহমান; খুলনার সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল কলেজের পিনাকমুগ্ধ দাস ‘বঙ্গবন্ধু সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ’-২০২৪ এর পক্ষে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী যথাক্রমে জেরিন তাসনীম রাইসা ও আল ফয়সাল বিন কাসেম কানন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্কলারর্স অ্যাওয়ার্ড’-২০২৩ এর পক্ষে অনুষ্ঠানে নিজ নিজ অনুভ‚তি ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন শিক্ষা ও গবেষণার কাজে আরও বরাদ্দ বাড়াই। ২০১০ থেকে বিনা পয়সায় বই দেওয়া শুরু করি। অনেকে ভেবেছে যে এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। ছেলেমেয়েরা যাতে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে, দেশ-বিদেশের কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রেখে বহুমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’ বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তিজ্ঞান ছাড়া কোনও দেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তখন কেউ কম্পিউটার ব্যবহার করতো না। টেলিফোন ছিল অ্যানালগ। আমরা টেলিফোন সিস্টেমকে ডিজিটালাইজ করি, কম্পিউটার শিক্ষার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু হয় দুই-তিনটা কম্পিউটার দিয়ে। ছেলেমেয়েরা যাতে উন্নত শিক্ষা নিতে পারে, তার ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। তাছাড়া আইন পাস করে ১২টা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি আমরা করে গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০১ সালে আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি আর বিএনপি সেটা বাতিল করে দেয়। ২০০৯ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন শিক্ষা ও গবেষণার কাজে আরও বরাদ্দ বাড়াই। ২০১০ থেকে বিনা পয়সায় বই দেওয়া শুরু করি। অনেকে ভেবেছে যে এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। ২০১০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৪৬৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৩ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিনাম‚ল্যে বিতরণ করেছি।’ ’৭৫-পরবর্তী যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা গবেষণায় কোনও বরাদ্দ দেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গবেষণায় আমাদের কোনও বরাদ্দ ছিল না। আমাদের প্রথম বাজেট ছিল অল্প। সেখান থেকেও গবেষণার জন্য টাকা দিই। পরের বাজেটে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়েছিলাম। সেটা ছিল কম্পিউটার শিক্ষা ও গবেষণায়। আমাদের শুধু একটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আমি আরও কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় করে দিই। সেই সঙ্গে ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, নভোথিয়েটার প্রতিষ্ঠা, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বায়ু টেকনোলজি ইনস্টিটিউট সব আওয়ামী লীগ সরকার আমলে শুরু করেছিলাম।’ প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনশীল বিশ্বে বৈশ্বিক মান বজায় রাখতে সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বহুমাত্রিক ও সৃজনশীল করেছে। আমরা বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেছি যাতে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপও তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যপুস্তকের কার্যপ্রণালি, শিক্ষাক্রম, সবকিছু আমরা পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে করছি। সৃজনশীল শিক্ষার ব্যবস্থা, মেধা অন্বেষণ, মেধার মাধ্যমে শিক্ষাকে আরও আপন করে নেওয়া, শিক্ষাকে আনন্দ মুহ‚র্ত পরিবেশে করা, সেই পদ্ধতিতে আমরা আসতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘সারাক্ষণ যদি কেউ বলে পড় পড় পড়, এটা কি ভালো লাগে বলো? মোটেই ভালো লাগে না। যা একটু পড়ার ইচ্ছা থাকে সেটাও নষ্ট হয়ে যায়। এটা বাস্তব কথা। সেজন্য এমন ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছি যাতে ছেলে মেয়েরা আগ্রহ নিয়ে পড়ে। পড় পড় করতে হবে না। নিজেরাই পড়বে।’ তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, সকল বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা-আমাদের তরুণ সমাজই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।