spot_img

শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদি শীর্ষ বৈঠক দুই দেশরেল সংযোগ বৃদ্ধিসহ ১০ সমঝোতা স্মারক সই বাংলাদেশি রোগীদের জন্য ই ভিসা চালু

দুই দেশের সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যত গড়তে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। গতকাল শনিবার নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের সামনে যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উভয় দেশই একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে আমাদের পথ দেখানোর জন্য ‘রূপকল্প ঘোষণা’ অনুমোদন করেছে। আমরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ‘ডিজিটাল অংশীদারিত্ব’ এবং ‘সবুজ অংশীদারিত্ব’ বিষয়ক দু’টি সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে কাজ করতে দু’পক্ষই সম্মত হয়েছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, আজ আমরা নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য একটি ভবিষ্যত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছি। সংযোগ, বাণিজ্য এবং সহযোগিতায় বৃদ্ধিতেই আমরা গুরুত্বারোপ করেছি।
শীর্ষ বৈঠক শেষে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক আরো সুসংহত করতে ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়ছে। এসব সমঝোতা স্মারকের মধ্যে সাতটি নতুন ও তিনটি নবায়ন করা হয়েছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে সংযোগ, স্বাস্থ্য, একাডেমিক সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক বিনিময় প্রত্যক্ষ করেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য ই ভিসা চালু, তিস্তায় কারিগরি টিম পাঠানোসহ দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে ১৩টি ঘোষণা এসেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত বিকশিত
এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে: শেখ হাসিনা
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিষয় যার মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের বিষয়টি উলে­খযোগ্যভাবে আলোচনায় এসেছে। আমরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ‘ডিজিটাল অংশীদারিত্ব’ এবং ‘সবুজ অংশীদারিত্ব’ বিষয়ক দু’টি সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে কাজ করতে সম্মত হয়েছি।
ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশি, বিশ^স্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার উলে­খ করে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সম্পর্ককে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত বিকশিত এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। আজ আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আমরা অন্যান্য পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের দুই দেশের এবং জনগণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি। নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথ-চলা শুরু করেছে, সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেই ধারাবাহিকতায় আমরা ‘রূপকল্প-২০৪১’ এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে, দুই দেশই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়সহ উচ্চপর্যায়ের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান আমাদের স্বাধীনতার এবং দু’দেশের মধ্যে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে তার শেষ দ্বিপাক্ষিক সফর করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আমন্ত্রিত ‘অতিথি দেশ’ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি বলেন, এখন আমি এই একই ‘জুন’ মাসে অভূতপূর্ব দ্বিতীয়বারের মতো নয়াদিলি­ সফর করছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসবই আমাদের এই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে একে-অপরের সঙ্গে কাজ করার প্রমাণ বহন করে।
শেখ হাসিনা উলে­খ করেন, আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে তারা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার পথ এবং কার্যপন্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, এই আলোচনাসমূহ আমাদের একে-অপরকে সহযোগিতার উন্নততর পথ নিরূপণে গুরুতপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দেবে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারত সরকার ও জনগণের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সেইসব বীরদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান এবং মোদিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।
তিস্তা নদীর সংরক্ষণ-ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে
বাংলাদেশে যাবে কারিগরি দল: নরেন্দ্র মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনা করতে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা সুবিধা চালু করবে। এছাড়া বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে রংপুরে একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে মোদি বলেন, গত এক বছরে প্রায় ১০ বার দেখা হলেও আজকের বৈঠকটি বিশেষ কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সরকারের তৃতীয় মেয়াদে প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। বাংলাদেশ আমাদের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি, অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি, ভিশন সাগর এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের কেন্দ্রে অবস্থিত। বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার এবং আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই।
তিনি বলেন, গত এক বছরে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমূলক প্রকল্প একসঙ্গে সম্পন্ন করেছি। আখাউড়া-আগরতলার মধ্যে ৬ষ্ঠ ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছে। খুলনা-মংলা বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য কার্গো সুবিধা চালু হয়েছে। মংলা বন্দর প্রথমবারের মতো রেলপথে যুক্ত হয়েছে। ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটই উৎপাদন শুরু করেছে। দুই দেশের মধ্যে ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রথম উদাহরণ হয়ে উঠেছে। মাত্র এক বছরে এ ধরনের বড় উদ্যোগের বাস্তবায়ন মধ্যে আমাদের সম্পর্কের গতি এবং মাত্রা প্রতিফলিত করে।
আজ আমরা নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য একটি ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছি। গ্রিন পার্টনারশিপ, ডিজিটাল পার্টনারশিপ, বøু ইকোনমি, মহাকাশের মতো অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের তরুণরা উপকৃত হবে। ভারত বাংলাদেশ ‘মৈত্রী স্যাটেলাইট’ আমাদের অংশীদারিত্বকে নতুন উচ্চতা দেবে। তিনি বলেন, গত দশ বছরে, আমরা ১৯৬৫ সালের আগে বিদ্যমান সংযোগ পুনঃস্থাপন করেছি। এখন আমরা ডিজিটাল এবং জ্বালানি সংযোগের উপর আরও বেশি মনোযোগ দেব। এতে উভয় দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিতে উভয় পক্ষই সেপা (সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি) নিয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো নির্মাণে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, ৫৪টি নদী ভারত ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে। আমরা বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, সুপেয় পানি প্রকল্পে সহযোগিতা করছি। আমরা ১৯৯৬ সালের গঙ্গা জল চুক্তির নবায়নের জন্য প্রযুক্তিগত স্তরের আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, প্রতিরক্ষা উৎপাদন থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন পর্যন্ত আমাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও জোরদার করার বিষয়ে আমরা বিস্তৃত আলোচনা করেছি। সীমান্তের শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি বলেন, ভারত মহাসাগর অঞ্চলে, আমাদের একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক ওশেন ইনিশিয়েটিভ-এ যোগদানে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা বিমসটেক সহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, আজ সন্ধ্যায় (শনিবার অনুষ্ঠিত) ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচের জন্য উভয় দলকে শুভকামনা জানাই। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। মোদি বলেন, সোনার বাংলায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাই। আমি আত্মবিশ্বাসী যে একসঙ্গে আমরা ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ এর রূপকল্প বাস্তবায়ন করব।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ