আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল প্লাটিনাম জয়ন্তী আজ। দেশের সব সূচকে অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে আজ ৭৫ বছরে পা দিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী দলটি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কেএম দাস লেনে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘রোজ গার্ডেন’ প্রাঙ্গণে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংগঠনটির প্রথম কমিটিতে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে থাকা অবস্থায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরের বছর ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর প‚র্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল হয়। সেই কাউন্সিলেই দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। আর ‘প‚র্ব পাকিস্তান’ শব্দ দুইটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে প্রবাসী সরকারের সব কাগজপত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার শুরু হয়। দীর্ঘ এই পথচলায় ৪৩ বছর ধরে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দীর্ঘ উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতায় দলটি টানা চার মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। পৃথিবীর খুব কম সংগঠন আছে যারা ধারাবাহিক সাফল্য নিয়ে ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। দীর্ঘ এই পথচলায় সংগঠনটি বাঙালি জাতির অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে সফলতার মুকুটে সংযুক্ত করেছে একের পর এক পালক।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যে ছয় দফা দাবি দেওয়া হয়, সেটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ। এরপর ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ভ‚মিকার কারণে দলটি এ অঞ্চলের নেতৃত্বে চলে আসে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ১৯৭০ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগকে বিপুল বিজয় এনে দেয়। সেই বিজয়ের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। ‘বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-বাংলাদেশ’ ইতিহাসে এই তিনটি নাম অমলিন, অবিনশ্বর। বাঙালী জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জš§ নেয়া দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময়ই গেছে লড়াই-সংগ্রামে। সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির অর্জন অনেক। আওয়ামী লীগ মানেই জাতির অর্জন, সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার স্বর্ণালি দিন।
১৯৭৫ সালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য। তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় তখন প্রাণে বেঁচে যান। এরপর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। সেই সরকার পাঁচ বছর মেয়াদ প‚র্ণ করে ক্ষমতা ছাড়ে। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২২টি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে। সম্মেলনগুলোতে বঙ্গবন্ধুসহ দেশবরণ্যে অনেক নেতাই কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার মধ্যে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ দশমবার দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিসহ সব পদ মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু ২৬ বছর দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা টানা সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ এই চলার পথে আওয়ামী লীগের সামনে এসেছে নানা বাধা-বিপত্তি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা থেকে শুরু করে, সামরিক জান্তাদের রোষানল, নিষেধাজ্ঞা, হামলা-মামলাসহ কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বারবার হোঁচট খেয়ে দলটি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন যতটুকু শক্তিশালী, তা যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ঈর্ষণীয়। আওয়ামী লীগ মানেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূল ধারা। বাংলাদেশের কাদা-মাটি গায়ে মাখা খেটে খাওয়া মানুষের কাফেলা। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্য ও অর্জনের নাম আওয়ামী লীগ। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভ‚মিকা প্রত্যুজ্জল।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে ষড়যন্ত্রের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বারবার মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে, দলটি উজ্জ্বলতর হয়েছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় পচাত্তরে কারাগারে ঘাতকদের হাতে নিহত জাতীয় নেতাদের অন্যতম এএইচএম কামররুজ্জামানকে। সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন মো. জিল্লুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আসে আওয়ামী লীগের ওপর মরণাঘাত। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি আবারও স্থগিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে ঘরোয়া রাজনীতি চালু হলে আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে মহিউদ্দিন আহমেদ ও বর্তমান সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে। ১৯৭৭ সালে এই কমিটি ভেঙ্গে করা হয় আহŸায়ক কমিটি। এতে দলের আহŸায়ক করা হয় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে। ১৯৭৮ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি করা হয় আবদুল মালেক উকিলকে এবং সাধারণ সম্পাদক হন আব্দুর রাজ্জাক। এরপরই শুরু হয় আওয়ামী লীগের উত্থানপর্ব, উপমহাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়া। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দলের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে নির্বাসনে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশে ফেরার আগেই ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন আবদুর রাজ্জাক। আবারও আঘাত আসে দলটির ওপর। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের একটি অংশ পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে বাকশাল গঠন করে। এ সময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক হন।
বঙ্গবন্ধু, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ প্রধানমন্ত্রীর: আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের সকল নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী এবং দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। শেখ হাসিনা বলেন, আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক সামসুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় চার নেতা, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদগণসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহিদ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের-যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি এবং আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের গণমানুষের প্রাণের সর্ববৃহৎ সংগঠন।
৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী (প্লাটিনাম জয়ন্তী) উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে ১০ দফা কর্মস‚চি ঘোষণা করেছে এবং ধারাবাহিকভাবে কর্মস‚চি পালিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- আজ রবিবার সূর্যোদয়ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৭টায় ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল সাড়ে ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মস‚চির উদ্বোধন করা হবে। এরপর দুপুর ২ টা ৩০মিনিটে আলোচনা সভা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুষ্ঠানে বিএনপির ছয় নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলে জাঁকজমকপ‚র্ণভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের জেলা/মহানগর, উপজেলা/থানা, পৌর/ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড শাখাসহ সকল স্তরের নেতা-কর্মী সমর্থকদের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপললেক্ষ আজ রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে থাকছে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ লক্ষ্যে রোজ গার্ডেন সেজেছে নতুন সাজে। আগামীকাল সোমবার ২৪ জুন সন্ধ্যায় হাতিরঝিল এমফি থিয়েটারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জুন হবে সাইকেল র্যালি। এছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘সবুজ ধরিত্রী’ নামে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মস‚চি হাতে নেওয়া হয়েছে।