spot_img

আতঙ্ক নাম রাসেলস ভাইপার

রাজধানীর অদূরে ধামরাই উপজেলায় নাতনির বিয়ের উৎসবে আদা-রসুন বাটার সময় বিষাক্ত সাপ কামড় দেয় এক বৃদ্ধাকে। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সকালে ঘটনার পরই তাকে নেওয়া হয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে পথিমধ্যেই তার মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা বলছেন, রাসেল’স ভাইপারের (চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া) কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। বিয়ের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে ছেয়ে যায়। এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সাপ আতঙ্ক।
রাজধানীর পাশের জেলা মানিকগঞ্জে গত তিন মাসে সাপটির কামড়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত পাঁচজন। ঢাকার সীমান্ত জেলা ফরিদপুরের পদ্মার তীর ও আড়িয়াল খাঁ চরাঞ্চলে গত ছয় মাসে সাপটির কামড়ে দুই শিশুসহ ৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গত বুধবারও (১৮ জুন) দেখা গেছে সাপাটিকে। ফলে জেলা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চাষিররা ভয়ে জমিতে যেতে চাচ্ছেন না। এছাড়াও দেশের সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ উপজেলা ভোলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গত পাঁচদিনে উদ্ধার করা হয়েছে ১২টি রাসেলস ভাইপার। আতঙ্কিত এলাকাবাসী ১১টি সাপকেই মেরে ফেলেছেন।
মূল সংবাদমাধ্যমের বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে রাসেল’স ভাইপার সাপের বিষয়টি। একইসঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সাপটি মারতে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন ফরিদপুরের এক আওয়ামী লীগ নেতা। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) শহরের রাসেল স্কয়ারের জেলা কার্যালয়ে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রস্তুতি সভায় ঘোষণাটি দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ইশতিয়াক আরিফ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেড় দুই দশক ধরে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচিতি পেলেও রাসেল’স ভাইপার এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। কয়েক বছর ধরে সাপটির দেখা মিলছিল শুধু পদ্মার তীরবর্তী জেলাগুলোতে। চলতি বছরে দেশের অন্তত ২৫টি জেলায় সাপটির বিচরণ দেখা গেছে। বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে সাপটি পৌঁছে গেছে এখন উপক‚লীয় অঞ্চল চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল অবধি। সবচেয়ে বেশি আনাগোনা মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুরসহ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার অববাহিকায়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গেল ২০২০ সালের বর্ষাকালে করোনা মহামারির মধ্যেই রাজশাহীর পাশের জেলা পাবনায় হঠাৎ করেই রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেড়ে যায়। পদ্মার চরের ফসলের মাঠ, ঝোপঝাড় এমনকি বসতবাড়িতেও ব্যাপকহারে দেখা যায় সাপটিকে। এতে জেলাজুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। সাপের কামড়ে প্রাণও হারান অনেকে।
এরপর গেল বছরের শেষের দিকেও হঠাৎ করেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের কয়েকটি গ্রামে সাপটির উপদ্রব বেড়ে যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় ফসল পরিচর্যা কিংবা পাকা আমন ধান কাটার শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। কৃষকরা সে সময় দাবি করেন, কয়েক বছর ধরেই তাদের ধানের জমিতে ব্যাপকহারে রাসেলস ভাইপার ছড়িয়ে পড়েছে। সে সময় সাপের কামড়ে প্রাণহানিও বেড়ে যায়।
চলতি বছরে রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে ইতোমধ্যে ১৫ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই কৃষক ও জেলে। বিষধর হিসেবে রাসেলস ভাইপার বিশ্বে পঞ্চম স্থানে থাকলেও হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে প্রথম অবস্থান। আক্রমণের ক্ষেত্রে সাপটি এতটাই ক্ষিপ্র যে ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ে কামড়ের প্রক্রিয়া শেষ করে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপের মধ্যে ৩০ প্রজাতিই বিষধর। সবচেয়ে বেশি বিষধর রাসেলস ভাইপার। তবে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সাপটির বিচরণ ভারত, ভুটান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, চীন ও মিয়ানমারেও। এটি সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের খেতে বাস করে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেল’স ভাইপারের প্রজননকাল মে থেকে জুলাই পর্যন্ত। যে কারণে সাপটির দেখা মিলছে বেশি। সাপটির অভিযোজন ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আগামীতে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের সরীসৃপ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ সোহেল রানা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের শুষ্ক এক ফসলী জমিতে ইঁদুর ক্ষেতে আনা গোনা ছিল বেশি। তবে এখন দুই তিন ফসলী জমি বেড়ে যাওয়ায় খাবারের যোগানও বাড়ছে। ফলে সাপটির প্রজনন বেড়ে যাচ্ছে।
সা¤প্রতিক রাসেল’স ভাইপারের সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সোহেল রানা বলেন, আগের চেয়ে সাপটির নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। এমনকি কচুরিপানার মতো ভাসমান কোনো কিছুর সঙ্গে ভেসে ভাটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই বলছেন, খেতের সবজি, ফসল বা কৃষিপণ্যের সঙ্গেও সাপটির স্থানান্তর ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে রাসেল’স ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও মানুষের ঝুঁকির বিষয়ে ২০১৮ সালে ‘জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইাটিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাতেই রয়েছে রাসেল’স ভাইপারের উপস্থিতি। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এসব জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচরণ ছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোখলেসুর রহমান বলেন, রাসেল’স ভাইপার প্রজাতিকে তাদের মতো করেই প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে দিতে হবে। এতে তারা কারো ক্ষতি করবে না। সাপটির যেমন ক্ষতিকর দিক আছে, তেমনি সামাজিক ইকোসিস্টেমে উপকারী দিকও আছে। সেটা মানুষকে বোঝাতে হবে। যখনই সাপটি নিয়ে ‘ইন্টারফেয়ার’ করা হবে তখনই ওরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে।
সাপ বিষয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে সুপরিচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসানও বললেন, রাসেল’স ভাইপার নিয়ে অনেকে না জেনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সাপ দেখে সবাই ভয় পায় এবং এর কামড়ে মারা যায় এটাই মনে গেঁথে গেছে। চিকিৎসা নিলে যে ভালো হয়, সেটা সবাই জানে না বলেই আতঙ্ক হয়। তবে এই সাপে কামড়ালে ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা নেওয়া না হলে মৃত্যু হতে পারে। তাই খুব দ্রæত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেই সমাধান অনেকটা এগিয়ে নেওয়া যায়। তিনি বলেন, রাসেল’স ভাইপার গর্ত এবং ঝোপঝাড়ের মধ্যে থাকে, বর্ষা এলে এরা বেরিয়ে আসে। তাই বিলে যাওয়ার সময় গামবুট এবং জিন্স পরে নিরাপদে থাকা যাবে।
ফরিদ আহসান জানান, দেশের বিভিন্ন জেলায় আগে কিছু সংখ্যক রাসেল’স ভাইপার ছিল। তবে বংশবিস্তারের মতো পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় এই সাপের উপস্থিতি অন্য জেলাগুলোতে তেমন চোখে পড়েনি। তবে নব্বই দশক থেকে সেচ পদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দুই আর তিন ফসলি জমি বেড়েছে। ফলে জমিতে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ভালো খাবার আর বংশবিস্তারের যথাযথ পরিবেশ পাচ্ছে রাসেল’স ভাইপার। এতে সংখ্যা বাড়ছে।
তবে কৃষিবিদরা রাসেলস ভাইপারকে খাদ্য শৃংখল ও বাস্তু সংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মনে করছেন। তারা বলছেন, সাপটির কৃষিশ্রমিকদের জন্য যেমন আতংকের তেমনি কৃষি ফসলের উপকারি। এ সাপ ইদুর খেয়ে ফসল রক্ষাও করে।
কৃষিবিদ ও গবেষক সৈয়দা বদরুন নেসা বলেন, রাসেল’স ভাইপার জীববৈচিত্র্য ও সুস্থ ইকোসিস্টেমের জন্য অপরিহার্য। সাপটি ইঁদুরের মত প্রাণীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে যা ফসলের ক্ষতি করে। রাসেল ভাইপারর ওপর গবেষণা করলে বিষের ব্যবহার, জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে, যা মানুষের জন্য উপকারও হতে পারে। আর এজন্য সাপের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য বিশেষ সংরক্ষণ অঞ্চল স্থাপন করা যেতে পারে।
তবে এই কৃষিবিদ জানান, রাসেল’ল ভাইপার অত্যন্ত উর্বর প্রজনন সক্ষমতার প্রাণী। একটি মাদি সাপ একবারে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা প্রসব করতে পারে। কোনো কোনো সময় ৮০টি ও পর্যন্ত দেখা যায়। বাচ্চাগুলি ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে জন্মায় এবং প্রথম থেকেই বিষাক্ত হয়। এদের দ্রæত বংশবিস্তার তাদের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে, যা কৃষকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
শ্যোসাল মিডিয়া আতংক ছড়াচ্ছে, আমাদের কৃষকদের হাতে ধাঁরালো কাচি আছে এমন মন্তব্য করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আকতার বললেন, রাসেল’স ভাইপার নিয়ে লিখিতভাবে নির্দেশনা না দিলেও কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যেন এলাকায় গিয়ে কৃষকদের সচেতন করেন।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ