১৫ লাখ টাকার ‘ছাগলকান্ডে’ ফেঁসে গেছেন সাবেক জোট সরকারের কাষ্টমসের যুগ্ম কমিশনার মতিউর রহমান। তিনি ১১তম বিসিএস কাস্টমস ক্যাডারে যোগদান করেন। ২০০৬ সালে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে হাওয়া ভবনের সংযোগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। হাওয়া ভবনের যোগসাজশে শত কোটি টাকার মালিক হন মতিউর রহমান। ওই সময় প্রতিহিংসার শিকার কয়েকজন ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় তাকে ওএসডি করা হয়। ২০০৯ সালে তার আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে নিযুক্ত হন। এরপর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাবেক জোট সরকারের সময় তার সীমাহীন দুর্নীতি পরিণত হয় মহীরুহে। বর্তমানে ড. মতিউর রহমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাসাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি ঈদ উল আজহায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনে এক যুবক আলোচনায় আসেন। ওই যুবকের নাম মুশফিকুর রহমান ওরফে ইফাত। সোস্যাল মিডিয়া ১৫ লাখ টাকা ছাগল কিনে দম্ভোক্তি দেখায় ইফাত। এরপরই আলোচনার ঝড় ওঠে ওই যুবকের পরিচয় নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইফাতের বাবাই হল এনবিআরের সদস্য এবং কাস্টমস, এক্সাসাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমান।
অপরদিকে, সোস্যাল মিডিয়ায় ছাগলসহ ইফাতের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর কানাডা থেকে ফারহানা রহমান ইফসিতা নামে একজন নারী ফেসবুকে উল্লেখ করেন যে ড. মতিউর রহমান তার বাবা। তার মায়ের নাম শাম্মী আখতার শিভলী। অর্থাৎ শিভলী মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী।
এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে টিসিবি ভবনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রাহমাতুল মুনিমকে এ বিষয়য়ে গণমাধ্যম কর্মীরা প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘এটা কোন প্রশ্ন নয়। এটা নিয়ে কোন প্রশ্নের জবাব দিব না।’
সূত্র জানায়, কোরবানি উপলক্ষে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনার বায়না দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আলোচিত হয়েছেন যুবক মুশফিকুর রহমান ইফাত। একাধিক ফেসবুক পোস্ট, কয়েকটি গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে ইফাত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাসাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মো. মতিউর রহমানের ছেলে। তবে মতিউর রহমানের দাবি, ইফাত নামে তার কোনো ছেলে নেই।
ইফাতের ভাষ্য, তিনি আসলে ছাগলটি কেনেননি। সাদিক এগ্রোর মালিকের কথামতো ছাগল কেনার ‘অভিনয়’ করেছেন। অন্যদিকে সাদিক এগ্রো বলছে, ছাগলটি কেনার জন্য এক লাখ টাকা বায়না দিলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হওয়ার পর আর কেনেননি তারা।
সাদিক এগ্রো কর্তৃপক্ষ বলছে, ইফাত ছাগলটি কেনার জন্য এক লাখ টাকা বায়না দিলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার পর আর নেননি।
এরপর ইফাতের বাবা রাজস্ব কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান দাবি করেছেন, যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, সেখানে থাকা ওই যুবককে তিনি চেনেনও না। তার একমাত্র ছেলের নাম আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, এনবিআরের সদস্য ড. মতিউর রহমান দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর নাম লাইলা কানিজ, যিনি বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মেয়ে ফারহানা রহমান ইফসিতা কানাডায় থাকেন। সেখানে ইফসিতার বিলাসবহুল জীবনাচরণ সোস্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় তুলেছে।
এদিকে ইফাতের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই বলে ড. মতিউর রহমান দাবি করলেও বৃহস্পতিবার ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী দেশের একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই তার বাবা।
নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, ‘ইফাত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে। ধারণা করছি, রাগ করে মতিউর রহমান ইফাতের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। মতিউর রহমান নিয়মিত দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।’
কে এই মতিউর রহমানঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন মতিউর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল বিসিএস যোগ দেন কাস্টমস বিভাগে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার দহরম মহরম সম্পর্ক ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের বিরুদ্ধে মতিউর রহমান উঠে পড়েন। ওয়ান ইলেভেনের সময় মতিউর রহমান এনবিআরে দোর্দন্ড প্রতাপশালী কর্মকর্তা। বদিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। এক পর্যায়ে মতিউরের প্রভাবে বদিউর রহমান এনবিআরের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন। ২০০৯ সালে মতিউর রহমান তার দলীয় পরিচয় পাল্টে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে চলাফেরা করেন। তৎকালীন একজন প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে যোগ দেয়ার পর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে কমিশনার হন তিনি। ২০২১ সালের ১২ আগস্ট তাকে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে সদস্য ( টেকনিক্যাল) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রæয়ারি থেকে তিনি ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত।