spot_img

চারুকলার বকুলতলায় বর্ষা বন্দনা

আষাঢ়ের ভোরে আকাশজুড়ে ছিল চলিষ্ণু মেঘের ওড়াউড়ি। তপ্ত নগরীতে বৃষ্টির প্রতীক্ষায় ছিল নগরবাসী। মেঘেদের ঘনঘটা ছিল বটে, তবে বৃষ্টি আর এলো না। বৃষ্টি আসুক না আসুক বৃষ্টিবিহীন নগরে নবীন শিল্পীরা নাচে গানে বর্ষা বন্দনায় মুখর করল চারুকলা প্রাঙ্গন। শুরুতে সম্মেলক কণ্ঠে তারা গাইলেন বৃষ্টির নামার গান ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’।
প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার শপথে গতকাল শনিবার ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষা উৎসব উদযাপন পরিষদ ‘বর্ষা উৎসব-১৪৩১’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সকাল সাড়ে ৭টায় বকুলতলার মঞ্চে মো. হাসান আলীর বাঁশিতে লোকজ সুর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ উৎসব।
উৎসবে শিল্পী সাজেদ আকবর পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসংগীত ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল’, সালমা আকবর পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি গাইলেন নজরুল সংগীত ‘বরষা ঐ এল বরষা’; অনিমা রায় শোনালেন রবীন্দ্রনাথের ‘নীল অম্বর ঘন কুঞ্জ ছায়ায়’, নবনীতা জাইদ চৌধুরী গেয়ে শোনান আধুনিক গান ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’।
এদিন একক কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করেন আবিদা রহমান সেতু, শ্রাবণী গুহ রায়, স্নিগ্ধা অধিকারী, রতœা সরকার, ফেরদৌসী কাকলী।
দলীয় সংগীত পর্বে বৃষ্টি নামার গানের সঙ্গে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে লোকসংগীত ‘গাঙ্গে যাইতাছে দেখো ভাই’। বহ্নিশিখা পরিবেশন করে নজরুল সংগীত ‘রুমুঝুম রুমুঝুম কে বাজায়’, সুরবিহার পরিবেশন করে লোকসংগীত ‘এসো শ্যামল সুন্দর’।
এদিন পঞ্চভাস্বর, সীমান্ত খেলাঘর আসর, সুরনন্দনের শিল্পীরা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনান বর্ষার গান।
আবৃত্তি পর্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী আহকাম উল্লাহ পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’।
ত্রপা মজুমদার পাঠ করেন ইন্দ্রানী সমাদ্দারের কবিতা ‘বৃষ্টি’, তিনি শোনান প্রদীপ বালার কবিতা ‘যে বৃষ্টির অপেক্ষায় বসে’। নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলি শোনান জয় গোস্বামীর কবিতা ‘মেঘ বালিকা’।
বর্ষা উৎসবে সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে ধৃতি নর্তনালয়, স্পন্দন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি অব ফাইন আর্টস, কথক নৃত্য স¤প্রদায়।
বর্ষা উৎসবের কথন পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বরেণ্য চিত্রশিল্পী আবুল বারক আলভী। বর্ষা উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. নিগার চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডীন নিসার হোসেন, বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি গোলাম মোস্তফা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৬নং ওয়ার্ড কমিশনার শহীদুল্লাহ মিনু। স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আবুল বারক আলভী বলেন, আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নগরে বসন্ত উৎসব, শরৎ উৎসব, নবান্ন উৎসব আর বর্ষা উৎসব পালন করি আমরা। এই বর্ষার এক আলাদা ব্যাপার আছে। তীব্র বৈশাখের পরে যখন বর্ষা আসে, তখন সবাই শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আমাদের শষ্য, গাছপালা আর ফলন যেটির কথা বলি না কেন, তার সবটাই বর্ষার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষার আকাশ যেমন কবিমনে প্রভাব ফেলে তেমনিভাবে আমাদের চিত্রশিল্পীদের ক্যানভাসেও বর্ষা প্রকাশিত হয়েছে আলাদা অনুভবে।
নগরে বৃক্ষায়নে গুরুত্বারোপ করে নিগার চৌধুরী বলেন, যারা বাড়িঘর বানাতে গিয়ে গাছ কেটে ফেলেছেন তারা আরও বেশি করে গাছ লাগান। আমরা প্রকৃতির বন্ধু হতে চাই।
পরে এই উৎসবের রীতি অনুযায়ী শিশুদের হাতে বনদ, ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষের চারা বিতরণ করেন অতিথিরা।
অপর দিকে ‘প্রাণ- প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বিশ্ব বিবেক’ ¯েøাগানে বর্ষা উৎসব উদযাপন করল উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ।
বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে সকাল ৭টায় উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী পন্ডিত অসিত কুমার দে’র রাগ সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বর্ষা উৎসবের সূচনা হয়। এরপর সমবেত গান, আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশন করেন ঢাকা মহানগর সংসদের বন্ধুরা। এরপর বিভিন্ন শাখার বন্ধুরা গান, নৃত্য এ আবৃত্তি পরিবেশনার পাশাপাশি ছিল আমন্ত্রিত শিল্পীদের পরিবেশনা।
উৎসবে নজরুল গীতি পরিবেশন করেন নাহিয়ান দুরদানা সূচি। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন ডালিয়া আহমেদ। রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন সেমন্তী মঞ্জুরি। একক আবৃত্তি করেন আতিকুজ্জামান মির্জা। এ ছাড়া একক সংগীত পরিবেশন করেন মায়েশা সুলতানা উর্বি, অবিনাশ বাউল, রবিউল হাসান এবং বন্ধুদের নিয়ে কোলাজ সংগীত পরিবেশন করেন মীর। বর্ষা উৎসবের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শিখা সেনগুপ্তা ও আতিকুজ্জামান মির্জা।
ঢাকা মহানগর উদীচীর সভাপতি নিবাস দে সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বর্ষা কথনপর্বে আলোচক হিসেবে ছিলেন কৃষি ও কৃষক বন্ধু রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি ও বর্ষা উৎসব উদযাপন কমিটির আহŸায়ক হাবিবুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। ‘বর্ষাকথন’ উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলির সদস্য কবি রহমান মুফিজ। সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর উদীচীর সাধারণ সম্পাদক আরিফ নূর।
বর্ষা কথন পর্বে কৃষি ও কৃষক বন্ধু রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে যে উন্নয়নের ধ্বজা উড়ানো হচ্ছে সেটি আসলে কার উন্নয়ন? কথিত এ ‘উন্নয়ন’ কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? বাংলাদেশের বর্তমান ‘উন্নয়নযাত্রা’র এ মডেলের সুবিধাভোগী মূলত একচেটিয়া করপোরেট প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতিবাজ দখলদার ব্যক্তি ও লুটেরা গোষ্ঠী। আর এর শিকার দেশের প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। দেশের সম্পদ নদীনালা, খালবিল, বন-পাহাড়, উন্মুক্ত জমি লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে উন্নয়নের ধুয়া তুলে। এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর পুঁজির নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজটি নিশ্চিত করেছে রাষ্ট্র।
বক্তারা বলেন, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে প্রকল্প বা স্থাপনা গড়ে তোলা চলবে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করতে হবে। শহরে-বন্দরে সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছ কাটা, পশু-পাখির আবাসস্থল ধ্বংস করা চলবে না। অবিলম্বে দেশের বিলুপ্তপ্রায় পশু-পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হোক।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ