ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের নেপথ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ চোরাচালানের রুটের নিয়ন্ত্রক মাফিয়াদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্ত থেকে সরে গেছে তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যদিও খুনের ঘটনার পরপর ডিবি আনার খুনের কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম কারণ হিসাবে শনাক্ত করেছিল এইস্বর্ণ চোরাকারবারি নিয়ন্ত্রক মাফিয়াদের সংশ্লিষ্টতা। এখন আনার খুনের কারণ হিসাবে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে আনারের রাজনৈতিক দ্ব›দ্বকে প্রধান হিসাবে দেখছে। এনিয়ে তদন্তকারী সংস্থা ডিবি ইতোমধ্যে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু ও জেলা ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। এদের মধ্যে কাজী কামাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
তবে আনার খুনের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ৫ জনের কেউই পরিকল্পনাকারী নয়। আনার খুনের ঘটনায় গত ১৯ মে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতারকৃত শিমুল ভ‚ঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান ভাড়ায় কাজ করেছেন। তাদের প্রত্যেকে এজন্য মোটা অংকের টাকা পেয়েছেন।
তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ বলছে, এমপি আনার খুনের মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আখতারুজ্জামান শাহীন। তবে পলাতক আখতারুজ্জামান শাহীন আত্মগোপনে থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় এ ঘটনার সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি সোস্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, ‘আমি যদি আনারকে খুনই করব তাহলে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র দিয়ে বাসা ভাড়া করব কেন?’
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় মামলার তদন্তকাজ স্বাধীনভাবে এগিয়ে নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত সঠিকভাবে এগিয়ে চলছে। তদন্তে কারও হস্তক্ষেপ বা কোনো চাপ নেই। স্বাধীনভাবে আমরা তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
ওদিকে, কলকাতার বরাহনগরের ১৭/৩, মন্ডলপাড়া লেনে বসবাসকারী এমপি আনারের বিশ্বস্ত বন্ধু গোপাল বিশ্বাস আত্মগোপন করেছেন। গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য এমপি আনার ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মন্ডলপাড়া লেনের গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। ৫ দিন পর গোপাল বিশ্বাস বরাহনগর থানায় আনার নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করেন। এরপর ঢাকা থেকে তদন্তকারী সংস্থা ডিবি গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে তথ্যের জন্য কথা বলেন। গত ২৮ মে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটের সেফটি ট্যাংক থেকে ৩/৪ কেজি মাংস সদৃশ বস্তু উদ্ধারের পর গোপাল বিশ্বাস আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কলকাতার প্রতিনিধিরা গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে গেলেও তার দেখা পায়নি। কেউ কেউ বলছেন, আত্মগোপনে যাওয়ার আগে গোপাল বিশ্বাসের চলাফেরা রহস্যজনক ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালানের রুটগুলো প্রভাবশালী শিল্পগ্রæপ, এমপি ও রাজনৈতিক নেতারা মাফিয়া গডফাদার হিসাবে নিয়ন্ত্রন করে। এদের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীক একটি স্বর্ণ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক গ্রæপের এক চেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের কারণে আনারের গ্রæপ কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ঝিনাইদহ এলাকার রুট আনার নিয়ন্ত্রন করলেও তার প্রধান শেল্টারদাতা বাগেরহাটের একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা। তবে সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বিভাগের একটি জেলার একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকাসহ সারাদেশের স্বর্ণ ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নেন নির্বাচনের জন্য। এই মাফিয়া গ্রæপে রয়েছেন ঝিনাইদহের একজন সাবেক এমপি, যশোরের একজন সাবেক এমপি, ঢাকার শীর্ষ দুই জন স্বর্ণ ব্যবসায়ী (এক জনের বাড়ি চুয়াডাঙা), একজন ডেভেলপার কোম্পানীর মালিক ও দক্ষিণাঞ্চলের একজন সদ্য নির্বাচিত এমপি। এরাই সমাজে ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’ হিসাবে পরিচিত। এর মধ্যে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ ও মহেশপুর সীমান্ত সংশ্লিষ্ট স্বর্ণ চোরাকারবারি গ্রæপটি ঢাকার আরেকটি গ্রæপের স্বর্ণের তিনটি চালান আত্মসাত করে। এর প্রেক্ষিতে প্রতিপক্ষ গ্রæপ মাঝে মধ্যেই গোপনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বর্ণের চালানের খবর জানিয়ে দেয়। এখানেই শুরু হয় প্রকাশ্যে বিরোধ। যার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের বাংলাদেশের শক্তিশালী মাফিয়া গ্রæপটি এমপি আনারকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে।