হুমায়ুন আজাদ একইসঙ্গে দ্রোহী এবং শিল্পী। তিনি তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে ধর্মান্ধতা, উগ্রতা, ভন্ডামির বিরুদ্ধে আজীবন কলমে প্রতিরোধ গড়েছেন। এর ফলে তার উপর হামলা হয়েছে। শাসকের রক্তচক্ষু বারবার চোখ রাঙিয়েছে, অথচ তিনি চাবুকের কষাঘাত চালিয়েছেন দুর্নীতিবাজ, খুনি, ভন্ডদের বিরুদ্ধে। তিনি আছেন, থাকবেন বাকস্বাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রতিটি মানুষের অনুপ্রেরণায়।
গতকাল বুধবার সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে চলমান আয়োজন ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক স্মরণ অনুষ্ঠানে ঔপন্যাসিক, কবি, গবেষক, ভাষা বিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘হুমায়ুন আজাদের বহুত্ববাদ ও বিনির্মাণ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাহিত্যিক ও গবেষক মোজাফফর হোসেন। আলোচক ছিলেন হুমায়ুন আজাদের কন্যা মৌলি আজাদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আগামী প্রকাশনীর কর্নধার ও মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি। শুরুতেই প্রদর্শিত হয় হুমায়ুন আজাদের জীবন ও কর্মের উপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র।
হুমায়ুন আজাদ একইসঙ্গে দ্রোহী এবং শিল্পী এমন মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রাবন্ধিক মোজাফফর হোসেন বলেন, আমাদের সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হুমায়ুন আজাদ সংগ্রাম করে গেছেন আমৃত্যু। তার রচনা ধর্মীয় কুসংস্কার-ধর্মান্ধতার উপর আঘাত হেনেছে লাগাতার। বাংলার বহুত্ববাদী লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে কখনোই উগ্র সা¤প্রদায়িকতাবোধ ছিল না। এই অসা¤প্রদায়িক সমন্বয়বাদী বোধকে তিনি সবসময় পৃষ্ঠপোষণ করেছেন। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা সংকটের মধ্যে পড়লে তিনি যোদ্ধারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর অস্ত্র হয়ে উঠেছে তাঁর ভাষা, সৃষ্টিশীল মানবিক চেতনা। স্বৈরাচার এবং স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষমতাকাঠামোর বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে বাংলাদেশ গঠনে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
তিনি বলেন, হুমায়ুন আজাদের সৌন্দর্যচেতনা শুধু নিসর্গকেন্দ্রিকে রোম্যান্টিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি অসা¤প্রদায়িক মানবিক সমাজের মধ্যে যে অন্তর্গত সৌন্দর্য থাকে, সেই সৌন্দর্যচেতনা প্রকাশ করার জন্যই লেখকসত্তাকে লালন করেছেন। সমাজের জন্য শিল্প নাকি শিল্পের জন্য শিল্প, এই ক্লাসিক বিতর্কটা হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রে ততটা খাটে না। তিনি একইসঙ্গে দ্রোহী এবং শিল্পী। তাঁর এই দুটো সত্তা পরস্পরের শক্তি ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
হুমায়ুন আজাদ স্রোতের প্রতিক‚লে চলা সত্য ভাষ্যের এক অনন্য পথিক উল্লেখ করে ওসমান গনি বলেন, হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুতে হয়তো শারীরিকভাবে বিলীন হয়েছেন। কিন্তু তার আদর্শ, তার মানবতাবোধ, তার সৃষ্টিকর্ম তো চিরকাল থাকবে। তিনি আছেন, থাকবেন বাকস্বাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রতিটি মানুষের অনুপ্রেরণায়। উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন দ্বীপ্তিমান আলোকশিখা হয়ে।
হুমায়ুন আজাদের বই প্রকাশের কারণে এখনও আমাকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয় উল্লেখ করে এই প্রকাশক নেতা আরো বলেন, দীর্ঘদিন পর হলেও হুমায়ুন আজাদকে সরকারিভাবে স্মরণ করা হচ্ছে তার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশ আগের অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে এটা আশার কথা।
আলোচনা শেষে কবিতা আবৃত্তি করেন ডালিয়া আহমেদ ও মজুমদার বিপ্লব।
একই মঞ্চে স্মরণ করা হয় দেশের বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যক, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।
অনুষ্ঠানে আবদুল গাফফার চৌধুরীর জীবন ও কর্মের উপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত ১০ মিনিটের বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। পরে আবদুল গাফফার চৌধুরীর জীবন ও কর্মের উপর ‘আবদুল গাফফার চৌধুরী: ত্রিমাত্রিম জীবন সংবেদে চৈতন্যের বাতিঘর’ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক নজরুল কবির। আলোচক ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারাবান তাহুরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ।
অনুষ্ঠানের প্রাবন্ধিক নজরুল কবির বলেণ, এ কথা আজ ইতিহাস সিদ্ধ যে, অখন্ড ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র, যিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের গাড়িটি চালিয়েছিলেন সাংষ্কৃতিক আন্দোলনের জ্বালানীতে। বস্তুত এ কারণেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে রাজনীতি ও সংস্কৃতি পথ চলেছে হাতে হাত রেখে। রাজনৈতিক স্থানাঙ্কে সংস্কৃতির অবস্থানটিকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র এখনো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি, পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর এই বিশ্লেষণ উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমরা পাই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখনী থেকে। এমন কি তাঁর ব্যক্তিজীবনের ধারাপাতেও আমরা দেখি এই দর্শনের গভীর অভিঘাত। তিনি তাঁর গোটা জীবনে রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই সমান্তরাল আলপথ ধরেই হেঁটে গেছেন। ফলে উত্তরকালে আমরা দেখতে পাই সুমহান ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রæয়ারিকে নিয়ে রচিত তাঁর অবিসংবাদিত ‘একুশের গান।’
আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবদুল গাফফার চৌধুরীর বিখ্যাত গান ‘আমার ভাইয়ে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি’ এবং ‘জাগো নাগিনীরা জাগো’ পরিবেশন করেন ঢাকা সাংস্কৃতিক দলের শিল্পী রোকসানা আক্তার রুপসা, সুচিত্রা সূত্রধর, মো: সোহানুর রহমান, হিমাদ্রি রায়, হিরক সরদার ও সৌভিক পাল।