spot_img

অর্থনীতির খাতকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে —– অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। শুধু আয় ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে এই দুর্বলতা কাটানো যাবে না। এই পরিস্থিতিতে বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন দরকার। কিন্তু সরকারের উচ্চতম মহলে সেই উদ্যোগ আছে কি না এমন প্রশ্ন তোলেন অথনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন অনুগত স্বার্থগোষ্ঠীকে ব্যাংক থেকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি সম্পৃক্ত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে, বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সৎ উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হন। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আর্থিক খাতসহ কিছু সংবেদনশীল খাতকে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। দেশ থেকে পুঁজি পাচার হচ্ছে; ব্যাংক খাত আছে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজেট যেন হাত-পা বাঁধা বলির পশুর মতো, তার কিছু করার নেই। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪-২৫ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে আয়োজি এই অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ এমপি, দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক এড. সালমা ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পদাক ও দৈনিক বনিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। আলোচন সভঅয় এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শীত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সমালোচনা করা হয়। পাশাপাশি বাজেট ভর্তুকির অর্থ যোগাতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। তারা বলেন, এর প্রভাবে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ সংকুচিত হবে। বক্তৃতায় দেশের অর্থনীতির এক বিশৃঙ্খল পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেন অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, অর্থনীতির সবচেয়ে সংবেদনশীল খাত ব্যাংকিং খাত এখন নিয়ন্ত্রণহীন ও অরক্ষিত। অর্থনীতিতে নেই আস্থার পরিবেশ। অবাধে কালো টাকার সঞ্চালন হচ্ছে। পাচার হচ্ছে অনেক টাকা। অর্থনীতিতে সমস্যা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এত দিন সেই সমস্যা হজম করার শক্তি অর্থনীতির ছিল। এখন সেই শক্তি নেই বলে এসব সমস্যা প্রকাশ্যে আসছে। এই বাস্তবতায় দৃঢ় পথ নির্দেশনা দরকার বলে মত দেন তিনি। ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরো বলেন, আমরা একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে এগুচ্ছি। এখন যে পথে অর্থনীতি চলছে, সেই পথের পরিবর্তন না হলে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বিশ্বের দুর্নীতি প্রায় সব দেশে আছে, কিন্তু বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর অন্যতম কারণ সারকারি সেবা পেতে নাগরিকদের অর্থব্যয় করতে হয়। এদেশে ঘুষ দেওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু ঘুষ খাওয়া অপরাধ। অথচ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে ঘুষ দেওয়াও অপরাধের মধ্যে গণ্য করা হয়।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি, যদিও দেশে অনেক দিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এটা বিবেচনাপ্রসূত হয়নি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, কর নীতি দেখে মনে হয়, বাঘের হরিণ শিকার করার নীতিতে চলছে রাজস্ব ব্যবস্থা। অর্থাৎ ছোট ও ক্ষমতাহীনদের চাপে রাখা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সরকার এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চায়। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, স্মার্ট মানুষ নীতিহীন হলে ভয়ংকর পরিস্থিতি হয়। সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, একটি গ্রæপ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ফুলে ফেপে উঠছে। এই বাজেটে সরাকার সুবিধাভোগীদের কথাই শুনেছেন। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার কমিয়ে আনলে ভর্তুকি আরো কমানো যেতো। সরকারের ব্যয়ে অপচয় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ আছে যেগুলোর কোন প্রয়োজন নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১১টি মন্ত্রণালয় দিয়ে চলছে। বাজেটের বড় অংশ চলে যাচ্ছে বেতন ভাতায়। প্রতিষ্ঠান সংখ্যা কমিয়ে এনে এসব খাতে খরচ কমানো সম্ভব।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুদ হার কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখা হয়েছে চারবছর ধরে। এখন সুদ হার বাড়ানোর প্রভাবে ডলারের দামও ১১৭ থেকে ১২১ টাকায় স্থির হয়েছে। এই স্থির অবস্থা আগামী দুই-তিন মাস থাকবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। ব্যাক্তিখাাতে বিনিয়োগ স্থবির উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি ঋণ নিবে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো যত টাকা বিতরণ করবে তার ৭৬ শতাংশই নিয়ে যাবে সরকার। তাহলে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে কী করে। মূল্যস্ফীতি কমাতে যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে সেটির সুফল পেতে অন্তত জানুয়ারি পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে। শ্রীল্কংার মূল্যস্ফীতিও ৭০ শতাংশ হয়েছিল, সঠিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি কমিয়ে এনেছে তারা। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সংস্কারের বিষয়গুলো নেই। ব্যাংকিং খাত ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুর হয়েগেছে। সাধারণ মানুষও ব্যাংকে গিয়ে নিজেদের টাকা তুলতে পারছে না। বাজেটের দর্শন হয়েগেছে সুবিধাবাদীদের সুবিধা তৈরি করা। নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ এমপি বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণে কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ বৃদ্ধি করলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। এর প্রভাবে বিনিয়োগ কমেগেলে কর্মসংস্থানে প্রভাব পরবে। এড. সালমা ইসলাম বলেন, এখন বিজ্ঞাপন প্রচারে অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো বিভিন্ন ধরণের সমস্যা মোকাবিলা করছে। সংবাদ পত্র শিল্পে সব ধরণের কর মওকুফের আহŸান জানান তিনি।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ