টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদি। গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি। এর মাধ্যমে কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরুর পর টানা তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি। তাকে শপথ পাঠ করান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। নরেন্দ্র মোদির পর একে-একে শপথ নেন তার মন্ত্রিসভার ৭২ সদস্য। প্রথমে শপথ নেন বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং। এরপর শপথ নেন মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যরা। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এনডিএ জোটের নেতাদের প্রায় ১১ ঘণ্টার বৈঠকে নতুন মন্ত্রিসভার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। তবে বিজেপি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো নিজেদের হাতেই রাখছে বলে জানা গেছে।
নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ সাত দেশের নেতারা। তারা হলেন, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংঘে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু, সিসিলিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ আফিফ, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবীন্দ কুমার জুগনাথ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ড এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী সেরিং তোবগে। এছাড়াও এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো ৮ হাজারের বেশি বিশিষ্টজনকে। যাদের মধ্যে ছিলেন, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিনোদন ও ক্রীড়াঙ্গণের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও অনেক বিরোধী নেতা অনুষ্ঠানে ছিলেন না। মোদির এবারের শপথ অনুষ্ঠানে যাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গতকাল কার্যত সাজ সাজ রব ছিল দিল্লিজুড়ে। রাজধানীতে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়। নেওয়া হয় তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দিল্লির উপর নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানস্থল ঘিরে মোতায়েন ছিল আড়াই হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য।
নেহেরুর পর টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী মোদি
কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালের নির্বাচনে জিতে তিনবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নেহেরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রতিটি জয়ই ছিল নিরঙ্কুশ। কারও সহায়তা ছাড়াই তিনি সরকার গড়েছিলেন। তবে এবার নরেন্দ্র মোদি সেখানে সফল হতে পারেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শরিকদের ওপর ভর করেই।
ভারতে সরকার গঠনের জন্য ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় প্রয়োজন ২৭২ আসন। গত দুই নির্বাচনের পর এনডিএ জোট সরকার গঠন করলেও নরেন্দ্র মোদির বিজেপি দুইবারই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু এবার বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তারা পেয়েছে ২৪০টি আসন। তবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছে ২৯৩ আসন। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট পেয়েছে ২৩৪টি আসন।
এবারের নির্বাচনে বিজেপির টার্গেট ছিলো ৩৭০ আসনে জয়লাভ করা। আর জোটগতভাবে চাওয়া ছিল ৪০০ আসনে জয়। লোকসভা নির্বাচনের সাত দফার ভোটগ্রহণ শেষ হয় গত ১ জুন। সেদিনই বিভিন্ন বুথ ফেরত জরিপের ফলে বলা হচ্ছিলো- গত দুইবারের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে সরকার গড়বে মোদির বিজেপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা বুথ ফেরত জরিপের ফল ভুল প্রমাণ হয়েছে। বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে আর ১০ বছর পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস। এবার তারা জিতেছে ৯৯টি আসনে।
এনডিএ জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠন করতে পারবে কি-না তা নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। কারণ বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠেছেন এনডিএ জোটের দুই নেতা তেলুগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জনতা দলের (ইউনাইটেড) নীতীশ কুমার। নির্বাচনে এই দুই দল ২৮টি আসনে জিতেছে। তারা সমর্থন না দিলে সরকার গড়তে পারবে না এনডিএ জোট। আবার তারা জোট বদলালে ক্ষমতায় আসতে পারে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট। এই দুই নেতার অতীতে বিভিন্ন সময় জোট বদলের ইতিহাস থাকায় সন্দেহ দানা বাধে। তবে গত বুধবার এই দুই নেতা এনডিএ জোটের নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে লিখিতভাবে সমর্থন দেন। শুক্রবার এমপিদের ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে এনডিএ জোটের নেতা নির্বাচিত হন মোদি। জোটের শরিকদের সমর্থনের বদলে নরেন্দ্র মোদির দলকে কি ধরনের ছাড় দিতে হচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শরিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু মন্ত্রী পদ চাইছে।
বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের দাবি, এবারের নির্বাচনে ভারতের জনগণ নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। তবে শুক্রবার ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে মোদি পাল্টা বলেন, বিরোধিরা এবারের নির্বাচনের ফলকে আমাদের পরাজয় হিসেবে দেখাতে চাইছে। কিন্তু আমরা হারিনি। বিজেপি একা যত আসন পেয়েছে ইন্ডিয়া জোটের সবাই মিলে তত আসন পায়নি। তিনি ভোটারদের ধন্যবাদ দিয়ে জানান, দুর্নীতি ও দারিদ্র দূর করতে তিনি সব কিছু করবেন।
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট বিরোধী দলে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোটের লড়াই জারি থাকবে। একইসঙ্গে তারা সঠিক সময়ে সঠিক সুযোগের জন্য অপেক্ষা করবে। এদিকে বসতে চলেছে লোকসভার অধিবেশন। ১৫ জুনের কাছাকাছি সময়ে শুরু হতে পারে ১৮ তম লোকসভার প্রথম অধিবেশন। তা চলতে পারে ২২ জুন পর্যন্ত।
মোদির সামনে এখন যে চ্যালেঞ্জ
বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে দুইজন নেতা এখন হয়ে উঠেছেন ‘কিংমেকার’। প্রবীণ সাংবাদিক সঞ্জীব শ্রীবাস্তব বিবিসিকে বলেন, নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রাবু নাইডুর ক্রাচ ছাড়া এই সরকার চলতে পারবে না এবং নীতীশ কুমার তো হাওয়ার দিক বদলের মতো জোট বদলে ফেলেন। এখন এই দুটি ক্রাচ বিজেপির গলায় ঘণ্টার মতো হয়ে গেছে। তারা দুজনেই পুরানো ওস্তাদ খেলোয়ার এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। দুজনেরই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা রয়েছে। এই ক্ষমতার সমীকরণে তারা নিজেদের পাওনা বুঝে নেবেন। তারা নিজেদের দাবি তুলে ধরে বলবেন যে, আমাদের এটা চাই, তবেই জোটে থাকব।
গত ১০ বছর যখন সরকার চালিয়েছেন মোদি তখন ক্ষমতা পুরোটাই তার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাতেই থেকেছে, অন্য কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন না। কিন্তু এখন জোট সরকার হলে সেখানে অন্যরাও অংশগ্রহণ করবে, তাদের কথাও শুনতে হবে, তবেই সরকার চলতে পারবে।
সঞ্জীব শ্রীবাস্তব আরো বলেন, এর অর্থ হল জোট ধর্ম মেনে, বাজপেয়ী মডেল যদি গ্রহণ করা হয়, তবেই সরকার চালানো সম্ভব হবে। তার কথায়, মোদির জীবনে এই মডেলে কাজ করার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। গত ২২ বছরে তিনি তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে একরকম একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে কাজ করেছেন। এখন হঠাৎ করে সমন্বয় করে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজনীতি করা তার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই নতুন কাজের ধরণ তিনি কতটা গ্রহণ করতে পারবেন, তার ওপরেই এই সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে।
অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার যখন গঠিত হয় ১৯৯৯ সালে, তখন এনডিএ জোটে ২৪টি দল ছিল। সেই সরকার টিকেছিল পাঁচ বছর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জোটের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষমতাই বাজপেয়ী সরকারকে পাঁচ বছর টিকিয়ে রেখেছিল। খবর: এনডিটিভি ও বিবিসি।