পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড় এলাকার বাগজোলা খালের দক্ষিণ-পূর্ব পার থেকে উদ্ধার হল কাদা মাখা কিছু হাড়। পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি জানিয়েছে, এর মধ্যে কয়েকটি বেশ বড় বড়। উদ্ধার হওয়া হাড় মানুষের বলে মনে করা হচ্ছে। সেগুলো ঝিনাইদহ-৪ এর নিখোঁজ এমপি আনওয়ারুল আজিম আনারের কি না তার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি জানিয়েছে, এই ঘটনায় অভিযুক্ত সিয়াম হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা পরই ওই এলাকায় হাড় থাকার তথ্য মেলে। তারপরই গতকাল রবিবার সকালে কৃষ্ণমাটির বিজয়গড় বাজার সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হাড়গুলির সন্ধান পাওয়া যায়। ফরেনসিক দলের উপস্থিতিতে ওই এলাকা থেকে হাড়গুলি উদ্ধার হয়। ফরেনসিক পরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে, সেগুলি সাংসদের হাড় কি না। তল্লাশিতে ভারতীয় নৌসেনার একটি দল এবং কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ছিল।
সিয়ামের নির্দেশিত ৩টি জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে ওই হাড়গুলি। খালের ধারের দুটি জায়গার পাশাপাশি খালের ভেতর থেকে কিছু হাড় পাওয়া যায়। রবিবার সকালে মুখে কাপড়বাঁধা অবস্থায় সিয়ামকে নিয়ে সিআইডির বিশেষ তদন্তকারী অফিসাররা বাগজোলা খালে সংলগ্ন কৃষ্ণমাটি এলাকায় যান। আনার খুনের পর দেহ ও তথ্যপ্রমাণ লোপাটের ঘটনায় অভিযুক্ত সিয়াম জড়িত বলে তদন্তকারীদের দাবি। যদিও যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছিল, বা দেহ টুকরো করা হয়েছিল বলে বলা হচ্ছে সেগুলি এখনও পাওয়া যায়নি। সাংসদের দেহাংশ খোঁজার জন্য এর আগেও বাগজোলা খালে দু’দিন ধরে তল্লাশি চালিয়েছে ভারতীয় নৌসেনা। তার আগে বাগজোলা খালের সাপুলিয়া ও কৃষ্ণমাটি এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছিল সিআইডি। সাংসদ খুনের ঘটনার পর তদন্তে নিউ টাউনের ওই আবাসনের সেপটিক ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে উদ্ধার হয়েছিল কিছু মাংস সদৃশ বস্তু। সেগুলির ফরেনসিকর করা হচ্ছে।
হাড়গোড় উদ্ধারের পর কলকাতা পুলিশের ভাঙড় ডিভিশনের উত্তর কাশীপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, সাংসদ খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সিয়াম হোসেনকে ১৪ দিনের সিআইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে বারাসত আদালত। জানা গেছে, অভিযুক্ত সিয়াম নেপালে পালিয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নেপালে আটক হওয়ার কথা জানায়। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির দাবি, তাকে বনগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে উদ্ধার হওয়া হাড়গুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি গোটা গোটা। কয়েকটি হাড় হাত ও পায়ের। কিছু পাঁজরের। চপার, বা দাও দিয়ে আঘাতের কোনও চিহ্ন খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাড়গুলিতে আঘাত করা হয়েছিল বা সেগুলি থেকে মাংস চাঁচা হয়েছিল কি না, তা জানতে প্রয়োজনে সেগুলির ফরেনসিক পরীক্ষা করা হতে পারে।
তবে আনার হত্যার তদন্তের দায়িত্বে থাকা কলকাতা সিআইডির তফর থেকে হাড় উদ্ধারের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি আসেনি। জিজ্ঞাসাবাদে সিয়ামের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার সকালে তাকে নিয়ে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজার থানা এলাকার কৃষ্ণমাটিতে বাগজোলা খালে নামে সিআইডি পুলিশ।
বিচার নিয়ে পুলিশ যা বলছে
আনার হত্যাকান্ডের খবরের দিনই তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন শেরেবাংলা নগর থানায় তার বাবাকে খুনের উদ্দেশে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে কলকাতায় দায়ের করা হয় হত্যা মামলা। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, এই হত্যাকান্ডটি ভারতও তদন্ত করছে, আমাদের পুলিশও তদন্ত করছে। তদন্তের বিষয়ে দুই দেশ একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। যেখানে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে সেখানে তদন্ত হবে। আবার বাংলাদেশের আইনে আছে, বিদেশে যদি কোনো বাংলাদেশি অপরাধ করে থাকে সেই অপরাধীকে বাংলাদেশে এনেও বিচার করা যাবে। এ মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে গত ১ জুন নেপাল যান ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ। ৪ জুন বিকালে দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম। এই মামলায় আমাদের ও ভারতের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। দুই দেশের তদন্ত কর্মকর্তারা কাজ করছেন এই হত্যাকান্ড নিয়ে।
শিমুল ভ‚ঁইয়ার জবানবন্দিতে বাবুর সংশ্লিষ্টতা
শিমুল ভ‚ঁইয়ার জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজী কামাল আহমেদ বাবুর প্রসঙ্গ উঠে আসে এবং বাবুর সঙ্গে শিমুল ভ‚ঁইয়ার কিছু পরিকল্পনার কথা প্রকাশ পায় বলে জানিয়েছে ডিবি পুলিশ। রবিবার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান আসামি বাবুকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আবেদনে এ তথ্য জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এই মামলায় শিমুল ভ‚ঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভ‚ঁইয়া ওরফে আমান উল্লাহ সাঈদ, তানভীর ভ‚ঁইয়া ও শিলিস্তি রহমান ওরফে শিলাস্তি রহমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। শিমুল ভ‚ঁইয়ার জবানবন্দিতে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজী কামাল আহমেদ বাবুর প্রসঙ্গ উঠে আসে এবং বাবুর সঙ্গে শিমুল ভ‚ঁইয়ার কিছু পরিকল্পনার কথা প্রকাশ পায়। শিমুল ভ‚ঁইয়া তার জবানবন্দিতে আরও জানায়, সে গত ১৫ মে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসে ১৬ মে কামাল আহমেদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন। ১৭ মে তারা সাক্ষাৎ করেন। তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা বিভাগ ৮ জুন আলামত উদ্ধারের লক্ষ্যে শিমুল ভ‚ঁইয়ার লুটেরচর সাভারের ভাড়া বাসায় বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে অভিযান পরিচালনা করে। তার বাসায় একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। পরবর্তীতে মোবাইল ফোনের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলার ঘটনা পরবর্তী ১৬ মে থেকে হোয়াটসঅ্যাপে বাবুর সঙ্গে আসামি শিমুল ভ‚ঁইয়ার যোগাযোগ ও কথোপকথনের তথ্য রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় দেখা যায়, কামাল আহমেদ ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকায় অবস্থান করছিল। তাৎক্ষণিক সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাকে ৮ জুন রাত পৌনে ১২টার দিকে গ্রেফতার করা হয়।