রাষ্ট্রে বা সমাজে যখনই কোনো বিরূপ পরিস্থিতি সামনে আসে তখনই পথনাটকের মধ্য দিয়ে নাট্যকর্মীরা প্রতিবাদে আন্দোলনে গর্জে উঠে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রেখেছিল এ দেশের পথনাটক। এমনকি ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে পথনাটককে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা দেশের আনাচে-কানাচেও।
তাছাড়া দেশে মৌলবাদের আস্ফালন বেড়ে গেলেও পথে নেমে আসেন নাট্যকর্মী ও শিল্পীরা। বর্তমানে দেশে স্বৈরতন্ত্র কিংবা বিরূপ কোনো পরিস্থিতি না থাকলেও পুরো সমাজ ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সা¤প্রদায়িকতা, মৌলবাদ আর ধার করা সংস্কৃতি। সংকুচিত হয়ে আসছে সংস্কৃতি কর্মকান্ড। এমন পরিস্থিতিতে পথনাটক হয়ে উঠতে পারে প্রতিবাদের ভাষা। সমাজে চেতনা জাগরণ অসুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে বড় ভ‚মিকা রাখতে পারে পথনাটক। তবে দীর্ঘদিন ধরে পথ নাটকের সেই ভ‚মিকা নেই। বিশেষ দিবস বা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পথনাটক দেখা গেলেও আগের সেই মুখরতা নেই। অথচ এই পথ নাটকই হয়ে উঠতে পারে মৌলবাদ ঠেকানোর প্রধান অস্ত্র। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, এক ধরণের ভয়ের সংস্কৃতি, ডিজিটাল মিডিয়ার সর্বব্যাপী বিস্তার, ব্যস্ত নাগরিক জীবন ছাড়াও সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ কম হওয়ার কারণে পথ নাটকসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড গতি পাচ্ছে না। তাছাড়া বিগত সময়ে করোনাকালে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় ধাক্কা লাগে। যাতে স্থিমিত হয়ে পড়ে সংস্কৃতির গতি। এতে করে পথনাটক উৎসব মুখ থুবড়ে পড়েছে। যা আর কোনোভাবেই মাথা তুলতে পারছে না!
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, পথনাটক সবসময়ই প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থানে থাকে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সবার মধ্যে এক ধরণের ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করে। সবাই নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়, যেটাকে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ বলা হয়। তবে দেশে রাজনীতিসহ যত অন্যায় কাজ হচ্ছে, সেসবের প্রতিবাদ জানাতে পারে নাট্যকর্মীরা। কিন্তু নাট্যকর্মীরা স্তিমিত হয়ে গেছে। যারা সিরিয়াসলি পথনাটক করেন তারা যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে পারেন। মানুষ তাদের সমর্থন জানাত। এখন সেই রকম ভালো পথনাটক লেখাও হচ্ছে না বলেও আক্ষেপ করেন রামেন্দু মজুমদার।
দীর্ঘ সময় ধরে গ্রাম থিয়েটারের মধ্য দিয়ে নাটককে শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন গ্রাম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা, নাট্যব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এই নাট্যজন বলেন, বাংলাদেশের পথনাটক সরাসরি রাজনৈতিক ভ‚মিকা বা দায়বদ্ধতা হাতে তুলে নিয়ে নেমে যায় মাঠে। কিন্তু সেই দিন আর নেই। থিয়েটারকে এখন ‘এন্টারটেনমেন্ট’ হিসেবে দেখছে মানুষ। কারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সচেতনতা এবং চর্চার অভাবের কারণে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে এই শিল্প।
তিনি বলেন, আজকের এই রাজনীতি যেমন মুখ্য নয় নাট্যকর্মীদের কাছে, তেমনি রাজনীতির কাছেও নাট্যকর্মীরা মুখ্য নয়। যে কারণে শোষণ বঞ্চনার কথা সংস্কৃতি পথনাটক এবং গণসংগীত চর্চা অনেকটা গৌণ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, নাট্যশিল্পকে শুধু মাত্রই বিনোদন যারা ভাবেন তাদের জন্য নয় এই নাট্যক্রিয়া। কারণ এই ক্রিয়া বা থিয়েটার জনগণের থিয়েটার, গণমানুষের মুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত তার প্রয়োগ চিন্তা। যে নাট্যক্রিয়া থেকে রাষ্ট্রের বড় অংশ গণমানুষ পায় মুক্তির বাণী।
একই কথার প্রতিধ্বনি তুললেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। তিনি বললেন, আসলেই পথ নাটক এখন আর পথে নেই। এটা মুলত আন্দোলনের একটা প্ল্যাটফরম। দেশে যখন আন্দোলন থাকে না, রাজনীতি থাকে না তখন এটা নিস্তেজ হয়ে যায়। আবার যখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হবে তখন পথনাটক আবার সক্রিয় হবে। তবে পথ নাটকের এতো বিষয় আমাদের আছে। বিশেষকরে মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে পথনাটককে ব্যবহার করা যায়। এটা নিস্তেজ হওয়া উচিত না।
অবশ্য যে রাজনীতি দেশে আছে তা অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন। যারা পথ নাটক করেন তারাও এখন জনবিচ্ছিন্ন। এই জনবিচ্ছিন্নতার মধ্যে পথ নাটক হবে না। অধিকার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সন্ধানে ফিরতে হলে পথনাটক যারা করেন তাদের মানুষের কাছেই যেতে হবে। কারণ বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলনের বড় হাতিয়ার এই পথনাটক।
তিনি বলেন, মঞ্চ নাটক প্রগতিশীল মূল্যবোধ প্রচার করলেও উপস্থাপনার কারণে তা সীমাবদ্ধ থাকছে চার দেয়ালে। অর্থাৎ কৃষক মজুর শ্রমজীবী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে সেটা পৌঁছে না। এ রকম অবস্থার প্রেক্ষিতে আন্দোলনের চেষ্টা হয় পথনাটকের মধ্য দিয়ে কাঙ্খিত বক্তব্য প্রকাশ করবার, যাতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাছে নাটকের বক্তব্য পৌঁছায়। এই লক্ষ্য নিয়ে পথনাটক পথে ছিল এবং সমাজ রাজনীতি শ্রেণী সংগ্রামের বিষয়গুলো পথনাটকে তাই বিষয় হয়ে আসে বারবার, যা এখন নেই হয়ে গেছে।