সাড়ে তিন বছর ধরে গুম। তিনি বেঁচে আছেন, নাকি হত্যা করে লাশ গুম করেছে-বিষয়টি কেউ নিশ্চিত নয়। ছেলের সন্ধানে বাবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালকের লিখিত আবেদন করেও কোনো কিনারা পাননি। গুম হওয়া এই ব্যক্তির নাম হাবিব উল্লাহ (২৮)। তিনি সৌদি আরব প্রবাসী। সৌদি আরবে তার বাবা ও চাচার একটি তৈরি পোষাক বিক্রির দোকান রয়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে হাবিব উল্লাহ দেশে আসেন। কক্সবাজার সদর থানার বদর মোকাম এলাকায় তাদের বাড়ি। ২০২০ সালের ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় হাবিব উল্লাহ চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কে বা কারা তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে ২ অক্টোবর নিখোঁজের বাবা আব্দুল হাকিম কক্সবাজার সদর থানায় একটি জিডি করেন। জিডি দায়েরের পরদিন অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তি আব্দুল হাকিমের কাছে ফোন করে জানায় যে তার ছেলে তাদের কাছে আছে। ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তি। ওই সময় অপহরণকারীরা ভিকটিমকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর আশেপাশের এলাকায় অবস্থান করছিল বলে ফোনে জানায়। এরপর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা করে ৫ টি নম্বরে দেড় লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন হাকিম। এরপর থেকে মুক্তিপণ দাবি করা মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পায় তারা।
ভিকটিমের বাবা আব্দুল হাকিম বলেন, ছেলের সন্ধানে তিনি কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করে জানতে পারেন যে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকার মির্জা আহমদ মোহাম্মদ জানে আলম ও তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার তার ছেলেকে অপহরণ করেছেন। নাসরিন আক্তারের সঙ্গে তার ছেলের মোবাইল ফোনে কথোপথন বহুবার হয়েছে। এর জের ধরে তারা তার ছেলেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গুম করেছে বলে অভিযোগ করেন। পরে তিনি ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। আদালত পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়।
এদিকে, ছেলের সন্ধান চেয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, র্যাব মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।
কক্সবাজার শহরে বদর মোকাম এলাকায় আব্দুল হাকিমের বাড়ি। দীর্ঘ ৩৮ বছর সৌদি আরবে প্রবাস জীবন কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরে পৈত্রিক ব্যবসায় যুক্ত হন। সৌদি আরবের জেদ্দায় কাপড়ের দোকান পরিচালনার জন্য তার ছোট ভাই এবং বড় ছেলে হাবিব উল্যাহকে পাঠান। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর হাবিব উল্যাহ ছুটি কাটাতে দেশে ফিরেন। এরপরই ৩১ অক্টোবর রাত ১০ টার পর থেকে সৌদি প্রবাসী ওই যুবক নিখোঁজ হয়ে যায়।
এদিকে, ভিকটিমের বাবার দায়ের করা মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মোঃ আবুল কালাম।
এদিকে, সৌদি প্রবাসী যুবক নিখোঁজের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করা হয়। ভিকটিমের পরিবার তাকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো একটি ইউনিটে তাকে আটক করে রাখা হয়েছে। এক বছর আগেও একজন ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট থেকে ছাড়া পেয়ে এসে হাবিব উল্লাহ’র পরিবারের কাছে জানিয়েছেন যে ভিকটিম জীবিত রয়েছে।
আরেকটি সূত্র জানায়, পরকীয়ার জের ধরে মির্জা আহমদ মোহাম্মদ জানে আলম আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হাবিবকে অপহরণ করে লাশ গুম করেছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, নাসরিন আকতারের ছোট ভাই কামাল উদ্দিন ভিকটিমের সহপাঠী। একই ক্লাশে পড়ার কারণে ভিকটিম হাবিব উল্যাহ কামালদের বাসায় যাতায়াত ছিল। ২০১৩ সালে যাতায়াতের সুবাদে ভিকটিমের সঙ্গে নাসরনি আকতারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৫ সালে ভিকটিম সৌদি প্রবাসী হন। এরপর নাসরিনের বিয়ে হয়ে যায়। ২০১৯ সালে ভিকটিম দেশে ফিরে কক্সবাজারে আফরিন সুলতানা রিফার সঙ্গে বিয়ে হয়। তবে ভিকটিম হাবিব উল্লাহ বিয়ের পরও নাসরিন আক্তারের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন।
মামলার বাদী আব্দুল হাকিম বলেন, তার ছেলেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকার জাহাজ ব্যবসায়ী মির্জা মোঃ জানে আলম ও তার স্ত্রী নাসরিন আকতার যোগসাজশে অপহরণ করে হত্যা করে লাশ গুম করেছে
তিনি আরো বলেন, হাবিবের সর্বশেষ অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকায়। এই এলাকায় মির্জা ও তার স্ত্রী নাসরিনের বাড়ি। তার মানে হাবিবের নিখোঁজের সঙ্গে তাদের একটা যোগসূত্র রয়েছে।
কক্সবাজার আদালতে ভিকটিমের বাবার দায়ের করা মামলাটি তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর কক্সবাজার আদালতে তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোঃ আবুল কালাম চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার বাদীকে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের কোন আলামত না থাকায় জব্দ করা সম্ভব হয় নাই। এমনকি মামলার বাদীও এ সংক্রান্ত কোনো আলামত উপস্থাপন করতে পারেননি। ভিকটিম হাবিব উল্লাহর সন্ধানে চট্টগ্রামের সকল থানায় ছবি পাঠানো হয়। ভিকটিম নিখোঁজ হওয়ার খবর জানতে পেরে একটি বিকাশ প্রতারক চক্র ভিকটিমের বাবার মোবাইল ফোনে ফোন করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং ভিকটিমের বাবা ৫ টি নম্বরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পাঠান। মামলায় উল্লেখ করা দুই আসামীর বিরুদ্ধে অপহরণ ও লাশ গুমের অভিযোগের কোনো তথ্য ও প্রমান মিলেনি।
এ ব্যাপারে গতকাল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক মোঃ আবুল কালাম বলেন, আমরা ভিকটিমের মোবাইল ফোনের কললিষ্ট যাচাই -বাছাই করেছি। সাক্ষীদের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। কিন্তু ভিকটিমের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ কারণে মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।