ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকান্ডের নেপথ্যে রয়েছে তার উত্থান, স্বর্ণ চোরচালান, খুন-খারাবিসহ নানা অপরাধের বিষয় উঠে আসছে। রহস্য দেখা দিয়েছে তার হত্যাকান্ড ঘিরে। উঠছে নানা প্রশ্নও। তবে সব প্রশ্নের ভিড়ে একটি বিষয় সবাই জানতে চায়। কে এই এমপি আনার, তাকে ঘিরে এত আলোচনা কেন? দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারাদের রাজত্ব ছিল। সেই রাজত্বের মধ্যে এমপি আনারের উত্থার। তার হত্যার মূল পরিকল্পনকারী আকতারুজ্জামান শাহীন। আর হত্যাকান্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমান উল্লাহ। এমপি আনার ছাত্র জীবন থেকে ২৩টা মটরসাইকেল নিয়ে চলতেন। নিজে চালাতো লাল কালারের একটি মটর সাইকেল। অপর ২২টি মটর সাইকেলে চোরাচালানের সামগ্রী বহন করতো তার নিয়োজিত কর্মীরা। তারা ছিল বেতনর্ভুক্ত। একজন তার পিছনে বসে থাকতো। তার সঙ্গে চোরাচালানির মালামাল থাকতো। তার প্রতিটি গাড়িতে নাম্বার থাকতো। এই নাম্বর দেখে আইন-শঙ্খলা বাহিনী ছেড়ে দিতো। কারণ সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতি মাসে নির্ধারিত হারে টাকা দিতেন। এলাকাবাসী, স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে।
আনোয়ারুল আজিম আনারের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। এলাকাবাসী জানান, এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্র্ধষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিদের গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চরমপন্থিদের আশ্রয় ও হত্যাসহ ২২টি মামলা ছিল। এমপি আনার হত্যাকান্ডে কারা জড়িত তা নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। তাদের স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানির টাকার ভাগ অনেকে পেতেন। অনেকের কোন মিল নেই, কারখানা নেই। তাদের বাবা ছিলেন শ্রমিক ও দিনমজুর। এখন তারা হাজার কোটি টাকার মালিক। তারা দলীয় নেতা সেজে রয়েছেন। অনেকেই স্বীকৃতি রাজাকারের সন্তান।
১৯৮৪ সালে এমপি আনার এসএসসি পাশ করেছে। ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। আর সরকারি মাহতাবউদ্দিন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেছে ১৯৮৮ সালে। এইচএম এরশাদের সময় সোনা চোরাচালান ও মাদক পাচারের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যায়। মাইক্রো বাসে করে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা থেকে স্বর্ণ নিয়ে যেত সীমান্তবর্তী এলাকা, আর মাদক নিয়ে আসতো ঢাকায়। সে ওই এলাকায় একক আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৯৬ সালে প্রথমে কালিগঞ্জে পৌর মেম্বার ছিলেন। দুইবার মেয়র পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে পরাজিত হন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন তিনি। ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। ২০০৯ সালে এমপি আনার উপজেলার চেয়ারম্যান হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ সালে এমপি। সে আওয়ামী লীগের রাজনীতির আগে এরশাদের জাপা করতেন। এরপর বিএনপির রাজনীতি করতেন। ডা. টুটুল ২০০৯ সালে তাকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরেরদিন তার লাশ পাওয়া যায় নওগাঁওয়ের গোদাগাড়ি এলাকায়। ওই সময় তার পরিবার সন্দেহ করেছিল, এমপি আনার লাল দলের প্রধান ডা. টুটুলকে র্যাবের হাতে তুলে দিতে সহযোগিতা করেছিলেন। নিহত টুটুল হলেন এমপি আনার হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনের আপন চাচাতো ভাই। আর এমপি আনার হত্যাকান্ড বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়ার আপন ভগ্নিপতি। এই কারণে শাহীন ও শিমুল আগে থেকে এমপি আনারের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। শিমুলকে র্যাব দিয়েও মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন এমপি আনার। সে পালিয়ে নিজেকে বাঁচায়। শাহীন ও শিমুলের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল এমপি আনারের উপর। এরপর ৫০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দ্ব›দ্ব বাধে মাফিয়া চক্র ও শহীনের সঙ্গে। কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও দুই জন সাবেক এমপি এই মাফিয়া চক্রে রয়েছেন। তবে এককভাবে সব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এমপি আনার। মাফিয়ারা শাহীনকে দিয়ে তার ফুফাতো ভাই শিমুল ভ‚ঁইয়াকে কাজে লাগায় এমপি আনার হত্যাকান্ড ঘটাতে।
ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার এমপি আনারকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার। ১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের পাশাপাশি কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারেও জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর দশ দিন পর ওই বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত মাফিয়াদের কাছে যত টাকা, তারা নিজেরাই বাজেট দিতে পারে। দেশ-বিদেশে তাদের বিপুল সম্পদ।