spot_img

‘টাকাও গেল , প্রানও গেল’

গোপালগঞ্জ জেলার মোকসেদপুর থানার পদ্মপটি গ্রামের চা দোকানদার আবুল কাশেমের ছেলে রাসেল শেখ (২৪)। তিন ভাই বোনের মধ্যে রাসেল সবার বড়। রাসেল সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন পাঁচ বছর। দেশের ফেরের গত বছরের শেষ দিকে। দালালের প্রলোভনে পরে নিজের ও পরিবারের নির্ভরশীলদের অবস্থা পাল্টানোই উদ্দেশ্য ইউরোপে (ইতালী) যাওয়ার সিন্ধান্ত নেন। সুমন নামে একজন দালালের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকায় ইউরোপে যাবার চুক্তি করেন রাসেল। এ টাকার সিংহভাগই ধার দেনা করে যোগার করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকাও গেল, প্রানও গেল। অথচ দালাল সুমন বহাল তবিয়তে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে রাসেল শেখসহ ৮জন মারা যায়। গতকাল শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ঢাকা জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সায়েম ইমরানের উপস্থিতিতে স্বজনদের লাশ বুঝিয়ে দেয় পুলিশ। মরদেহ গ্রহনের সময় এভাবে অনুভতি ব্যক্ত করেন নিহত রাসেলের মামা মেহেদী হাসান। তিনি এই মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলে বর্নানা করেছেন।
ঘটনার বর্ননা দিয়ে তিনি বলেন, গত ১৫ জানুয়ারী রাসেলসহ ৮ জন এক সাথে লিবিয়া গিয়েছিল। ঘটনার দুই আগেই রাসেলের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। তখন রাসেল তাকে জানিয়েছিল, ‘মামা দুইদিন পরই আমরা নৌকা যোগে রওনা দেব। আমার জন্য দেয়া করবেন। এটাই ছিল শেষ কথা।’ এর কয়েক দিন পরই মৃত্যুর খবর জানতে পারি।
মেহেদী হাসান ঘটনা সম্পর্কে বলেন, এই ঘটনায় যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাদের কাছ থেকে শুনেছেন- ওই নৌকাটিতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩২ জনের ধারণ ক্ষমতা ছিল। কিন্তু সেখানে ৫২ জন যাত্রী নেওয়া হয়েছিল। নিহত এই আটজনসহ কয়েকজনকে রাখা হয়েছিল নৌকাটির পাটাতনের নিচে। দুর্ঘটনায় পড়ার পর নৌকাটিতে পানি উঠতে শুরু করলে এই আটজন আর বের হতে পারেনি।
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সরমঙ্গল গ্রামের নিহত মামুন শেখ। তার মরদেহ গ্রহণ করেন তার বড় ভাই সজিব শেখ। তিনি বলেন, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মামুন শেখ ছিল সবার ছোট। বহুকষ্টে ধার দেনা করে দালালকে দেওয়া হয়েছিল ১৩ লাখ টাকা। একই কথা জানিয়েছেন, একই উপজেলার কদমবাড়ি গ্রামের মৃত পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নিহত নয়ন বিশ্বাসের ভাই আকাশ বিশ্বাস।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঃ এই ঘটনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মরদেহ আইনি প্রক্রিয়া স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা যুবরাজ ও কামাল নামের দুই আসামিকে। এই দুই আসামির গ্রামের বাড়ি গোপলগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরে
। তাদেরকে রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্যাবলি পাওয়া গেছে, তা যাচাই করা হচ্ছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক চক্র, এদের সাথে যাদের কানেক্টিভিটি আছে দেশে এবং দেশের বাইরে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনিটরিং করছেন।
রাজৈর ও মুকসুদপুরে নিজ নিজ বাড়িতে দাফন সম্পন্ন ঃ টেকেরহাট (মাদারীপুর) সংবাদদাতা জানান, গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় মাদারীপুর জেলার রাজৈর ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার নিজ নিজ বাড়িতে কফিন পৌছলে পরিবার, প্রতিবেশী ও স্বজনদের মাঝে শুরু হয় শোকের মাতম। এলাকার শত শত শোকাহত স্বজনরা নিহতদের এক জন্য দেখার জন্য তাদের বাড়িতে ভিড় জমায় । পরে ধর্মীয় রীতি শেষে ৮জনের দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার লাশ আসার খবরে রাজৈর ও মুকসুদপুরের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় দাফনের প্রস্তুতি। কবর খোড়াসহ সকল প্রস্তুতি নেয় পরিবারের স্বজনেরা।
কী ঘটেছিল ঃ উন্নত জীবনের আশায় দালালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন মৃতরা। গত ১৪ ফেব্রæয়ারি লিবিয়া থেকে একটি নৌকায় ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন ৩৫ বাংলাদেশিসহ ৫৩ জন। নৌকাটি তিউনিসিয়া উপকূলে ডুবে গেলে ওই আট বাংলাদেশিসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়। অপর জন পাকিস্তানের নাগরিক বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল বিমান বন্দরে আসে আট বাংলাদেশির মৃতদেহ। মৃতরা হলেন- মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেনদিয়া গ্রামের সজল বৈরাগী (২২), কদমবাড়ি গ্রামের নয়ন বিশ্বাস (১৮), সরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখ (২৪), কোদালিয়া গ্রামের কাজী সজীব (১৮), কেশরদিয়া গ্রামের কায়সার খলিফা (৩৫) এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রিফাত শেখ (২৪), একই উপজেলার পদ্মপট্টি গ্রামের রাসেল শেখ (২৫) ও ইমরুল কায়েস আপন (২৩)। এই আটজনকে হত্যার অভিযোগে গত ১৯ এপ্রিল সাতজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন নিহত সজলের বাবা সুনীল বৈরাগী ।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ