প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাকে উৎখাত করলে পরবর্তীতে কে আসবে? কে ক্ষমতায় গিয়ে দেশের জন্য কাজ করবে? কাকে তারা আনতে চায় সেটা কিন্তু স্পষ্ট নয়। এ কারণে তারা জনগণের সাড়া পাচ্ছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সম্প্রতি থাইল্যান্ড সফরের অর্জন ও সফলতা তুলে ধরতে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রথমে লিখিত বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
দেশের রাজনীতি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাম চলে গেছে ৯০ ডিগ্রি ঘুরে। আমার একটা প্রশ্ন, বিশেষ করে যারা অতি বাম, সব সময় মনে করি তারা প্রোগ্রেসিভ দল, তারা খুবই গণমুখী দল ইত্যাদি। সেখানে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক আছে তারা আমাকে উৎখাত করবে। পরবর্তীতে কে আসবে তাহলে, সেটা কি ঠিক করতে পেরেছে? তিনি বলেন, ১৫ বছর আগে দেশের অবস্থাটা কী ছিলো, এখন কী কোনো পরিবর্তনই হয়নি? তারপরও দেশবিরোধী অনেকেই অপবাদ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তারা মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আন্দোলন করে যাচ্ছে কেউ রিফিউজিটিভ হয়ে বিদেশে বসে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে প্রতিদিন অনলাইনে বসে আন্দোলন সংগ্রাম করেই যাচ্ছে, নির্দেশ দিয়েই যাচ্ছে। যারা আন্দোলন করে করুক, আমরা তো বাধা দিচ্ছি না।’ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ যেভাবে বল প্রয়োগ করেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন দমাতে সরকার সেই কৌশল’ নেবে কিনা, পরিহাসের ছলে সেই প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের নতুন পথ নিয়ে নেওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আমরা যদি আমাদের পুলিশকে যদি বলে দিই যে আমেরিকার পুলিশ যেভাবে আন্দোলন থামায় সেটা অনুসরণ করতে পারে, সেটা কি বলে দেব? আমার মনে হয় এখন আমাদের পুলিশ আমেরিকান পুলিশদের অনুসরণ করতে পারে। কারণ আমরা তো ধৈর্য ধরতে বলেছিলাম, সেই ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের (বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষ) কথা মনে আছে? আমি বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে। যার কারণে পুলিশ ধৈর্য ধরায় তাদের পিটিয়ে মেরেছে, সেই সাথে তাদের হাসপাতালে আক্রমণ, গাড়ি পোড়ানো হয়। কাজেই আমার মনে হয়, এখন আমাদের পুলিশ কিন্তু আমেরিকান স্টাইলে আন্দোলন দমানোর ব্যবস্থাটা নিতে পারে।’ এসময় হাস্যরস করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয় সাংবাদিকরা এব্যাপারে আমাকে সমর্থন করবেন।
মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশসহ অন্যদের ‘সবক’ না দিয়ে আগে নিজ দেশের দিকে নজর দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনের পক্ষের বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগ এবং ‘গণহত্যা’ চালাতে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র যোগান দেওয়ারও সমালোচনা করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে গুলিতে দুই বাংলাদেশির নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের দেশে যে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুলি করে সাধারণ-নিরীহ মানুষগুলিকে হত্যা করা হচ্ছে, এটাতো তাদের দেখা উচিত। নিজের ঘরকে আগে সামলানো উচিত। গুলিতে এবং ছুরিকাঘাতের বিভিন্ন ঘটনায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদে জানানো হবে কি না, সেই প্রশ্ন রাখেন একজন সাংবাদিক। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অলরেডি প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আমেরিকায় বসেও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে, সেখানে আমাদের আওয়ামী লীগ খুব সোচ্চার আছে, আমাদের সহযোগী সংগঠন, এটার প্রতিবাদতো আমরা সবসময় করেই যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু প্রবাসী বাঙালি না, আমেরিকায়তো প্রতিনিয়ত মানুষ খুন করার একটা-ঘরের ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলেকে মা ধরে রেখেছে, তাকে গুলি করে মেরে ফেলে দিল। তার অপরাধটা কী ছিল? তার হাতে একটা কাঁচি ছিল। সেই কাঁচির ভয়ে তাকে গুলি করে মারা হল। সেটা সে হয়ত খেলাধুলা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করছিল। একজন মাজুর ব্যক্তি, যে পঙ্গু, হাঁটতে পারে না, চলতেও পারে না, সে নাকি প্রেসিডেন্টকে হুমকি দিয়েছে, ওই অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করল। আর স্কুল, বিভিন্ন শপিং মলে, রেস্তোরাঁয় অনবরত গুলি হচ্ছে, আর মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন কোনো দিন নাই বোধহয়, আমেরিকায় গুলি করে মানুষ না মারছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্য জায়গায় মানবাধিকারের কথা বলেও ফিলিস্তিনের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দুমুখো’ নীতি কেন? এই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমরা করে আসছি। যে দুমুখো নীতি কিসের জন্য? মানুষ খুন করলে, তারপর তাদেরকে টাকাও দেওয়া হয়, অস্ত্রও দেওয়া হয় মানুষ হত্যায়। অপর জায়গায় দেখা গেল, মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের দেশেওতো মানবাধিকারের কত বিরাট বিরাট প্রবক্তারা আছে, তারা এখন চুপ কেন? তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তারা চুপ কেন? কথা বলে না কেন? তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন। সাংবাদিক থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংস্থা, বাংলাদেশের বিষয়ে অনেক সোচ্চার, এখন কেন চুপ। সরকার আর মানবাধিকার সংস্থা চুপ থাকলেও সাধারণ মানুষ সোচ্চার হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী-শিশু হত্যা, হাসপাতালে বোমা হামলার প্রতিবাদে আজকে বিশ্ব জাগ্রত। এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। আর তারা অ্যারেস্ট করছে। সেটাই নাকি তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। নিজে ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে সবসময় যুদ্ধের বিপক্ষে থাকার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুদ্ধের ভয়াবহতা আমি নিজে দেখেছি। আমরা বন্দিখানায় ছিলাম আর শরণার্থী হিসাবে ছিলাম। আমি যেখানে সুযোগ পাই, আমার নিজের অভিজ্ঞতা ধরেই আমি মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কেন আমি এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কেন আমরা শান্তিপ‚র্ণভাবে সব সমাধান করতে পারি না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমাধান করতে পেরেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। যুদ্ধের ম‚লে অস্ত্র উৎপাদন ও অস্ত্র বিক্রি থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি সেটাও বলেছি, এই অস্ত্র প্রতিযোগিতাটা বন্ধ করে সেই টাকাটা মানুষের কল্যাণে বা জলবায়ু ফান্ডে দিয়ে দেন। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত তারা লাভবান, তারা জীবন-জীবিকা বাঁচাতে পারবে।’ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বাংলাদেশের জোরালো অবস্থানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে তো বললাম, আমরা সবসময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আছি। এবং আমি যেখানেই যাই, আমার কথা আমি বলবই। কারণ, সেখানে যেভাবে গণহত্যা চলছে, এটা অমানবিক।
যুক্তরাষ্ট্রে ৯০০ শিক্ষার্থী গ্রেফতারের ঘটনা বিএনপির অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়: যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ দমনের বলপ্রয়োগের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, আজকে ৯০০ ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক থেকে শুরু করে সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে এই আন্দোলন করার জন্য একমাত্র আমেরিকায়। আর এটা নাকি গণতন্ত্রের একটা অংশ। সেটাও আমাদের শুনতে হয়। যেভাবে একজন অধ্যাপককে জাপটে ধরে, মাটিতে ফেলে হ্যান্ডকাফ পরানো হল। ২০০১ সালের পর ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর বিএনপির সন্ত্রাসী, পুলিশ বাহিনী যেভাবে অত্যাচার করেছিল, সেই অত্যাচারের কথাটাই মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য তাদের কাছ থেকে আমাদের মানবাধিকারের সবক নিতে হয়। এটাই হচ্ছে, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের।’ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের বিষয়ে বিক্ষোভ দেখানোর বিষয়ে এক প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেখানে বিক্ষোভ হচ্ছে, সেখানেতো আমেরিকা সরকারের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ করছে। আমাদের এখানে আওয়ামী লীগ কার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করবে। আমরা আমাদের মতামত দিচ্ছি, আমরা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিচ্ছি। ফিলিস্তিনের শিশু-নারীদের জন্য তৃতীয় দফায় সহযোগিতা পাঠানোর প্রস্তুতি চলার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে আমরা সবসময় তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। যেখানে নির্যাতিত মানুষ, সেখানে বাংলাদেশ আছে, এটা আমি প্রমাণ করতে পারি।’
উপজেলা নির্বাচনে এক জায়গায় বউ, আরেক জায়গায় ছেলে-এটা ঠিক না: প্রধানমন্ত্রী বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতেই মন্ত্রী-এমপির পরিবারের সদস্যদের প্রার্থিতা না করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য পরিবার বলতে তিনি নিজে (মন্ত্রী বা এমপি), তার স্ত্রী ও ছেলে- মেয়েকে বুঝিয়েছেন বলেও ব্যাখ্যা দেন। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ফ্যামিলি ফর্মুলা কী? নিজে, ছেলে-মেয়ে স্ত্রী; এই তো? এর বাইরে তো পরিবার হয় না। একবার হিসাব করেন তো, কয়জনের (মন্ত্রী-এমপি) ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী ভোটে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম। কারণ হচ্ছে আমরা চাইছি ইলেকশনটা প্রভাবমুক্ত যেন হয়, মানুষ যেন স্বাভাবিকভাবে ভোটটা দিতে পারে। সেটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। তারা আগে নির্বাচন করেছেন। কেউ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, কেউ উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের তো রাজনৈতিক জীবনী আছে। তাদেরকে মানা করি কী করে? তবে এটা ঠিক, এক জায়গায় বউকে দিল, আরেক জায়গায় ছেলেকে দিল, এগুলো ঠিক না। কর্মীদের ম‚ল্যায়ন করা উচিত। সবকিছু নিজেরা নিয়ে নেব, আমার নেতাকর্মীদের জন্য কিছু রাখব না, এটা হয় না। সেই কথাটা আমি বলতে চেয়েছি। সবাই দাঁড়িয়েছে, নির্বাচন করছে, সেটার লক্ষ্য হল নির্বাচনকে অর্থবহ করা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রেখে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। সে ক্ষেত্রে যারাই জিতে আসে আসুক, মানুষ যাকে চাইবে সে-ই আসবে।’
যাদের নির্বাচন করার সক্ষমতা নেই, তারা ভোট বর্জন করে: প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ যতক্ষণ চাইবে, ততক্ষণই ক্ষমতায় থাকবে আওয়ামী লীগ। মানুষের কল্যাণে কাজ করি আমরা, এটা প্রমাণিত সত্য। যতো বাধাই আসুক, তা অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র জনগণের আস্থা-সমর্থনের কারণে। আওয়ামী লীগ কোনো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ডিক্টেটর মিলিটারির পকেট থেকে বের হয়নি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। যাদের নির্বাচন করার সক্ষমতা নেই, তারা ভোট বর্জন করেছে। বর্জন করে কেন? নির্বাচন করার মত সক্ষমতাই নাই। পার্লামেন্ট নির্বাচন করতে হলে জাতিকে দেখাতে হবে যে পরবর্তী নেতৃত্ব কে আসবে, প্রধানমন্ত্রী কে হবে, নেতা কে হবে? একটা নেতা দেখাতে হবে। আপনার কাছে উপযুক্ত নেতা না থাকলে তখন তো আপনাকে ছুতা খুঁজতে হয়। নির্বাচন করলাম না, বিরাট ব্যাপার দেখালাম। বাস্তবতা সেটাই। আমাদের দেশে সেটাই হচ্ছে। কারণ একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে যদি পাবলিকের কাছে নেতা হিসেবে দেখান, তারা তো সেটা মেনে নেবে না। পলাতক আসামিকে তো পাবলিক মেনে নেবে না। তিনি বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেই ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, রাজনীতি করতে গেলে তো ঝুঁকি নিতে হয়। পঁচাত্তরের পর আমাকে দেশে আসতে দেবে না। রেহানার (জাতির পিতার কনিষ্ঠকন্যা শেখ রেহানা) তো পাসপোর্টও রিনিউ করে দেয়নি। আমার বাবার খুনিরা পুরস্কারপ্রাপ্ত, যুদ্ধাপরাধী খুনিরা ক্ষমতায়। ওই অবস্থায় তো আমি দেশে ফিরে এসেছি। আমার ওপর বারবার আঘাত এসেছে। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি। এতবার বেঁচে গেলাম কেন, এটা হয়তো অনেকের ভালো লাগে না।’ কোনও দেশের নাম উল্লেখ না করেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক দেশে তো নির্বাচন হচ্ছে আমরা দেখবো। আমরা অবজারভার টিমও পাঠাবো। দেখি কেমন নির্বাচন হয়। সেখানকার মানুষ কেমন ভোট দেয়, আমরা দেখবো।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা হচ্ছে নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে আরো গণমুখি এবং স্বচ্ছ করা। এই প্রথম আমরা আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছি। আগে কখনও এটা করা হয়নি। অতীতে নির্বাচন কমিশন সম্প‚র্ণ আর্থিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওপর নির্ভরশীল ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার এটাকে সেখান থেকে মুক্ত করে সম্প‚র্ণ স্বায়ত্তশাসিত করে দিয়েছে। আলাদা বাজেট দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত করেছি যে, দেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন কোন কোন দল থেকে মানুষকে ভোটে না যেতে বলা হচ্ছে। প্রশ্নটা হচ্ছে মানুষ কেন ভোটে যাবেনা? এটাতো তার অধিকার। তার এলাকায় সে যাকে চায় তাকে সে ভোট দেবে। তাদের এই ভোটের অধিকারে হস্তক্ষেপ কেন? প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের পুরো নির্বাচনী ইতিহাস যদি আপনারা দেখেন সেই ’৭৫ সালের পর থেকে যতগুলো নির্বাচন, ‘৭৭ সালের ‘হ্যাঁ-না’ ভোট থেকে নিয়ে যতগুলো নির্বাচন প্রত্যেকটা নির্বাচনকে নিয়ে যদি তুলনা করা হয় তাহলে দেখবেন ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন প্রত্যেকটি নির্বাচনের তুলনায় সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার নির্বাচনই হয়েছে। যেটা আমাদের লক্ষ্য ছিল । কারণ, এদেশে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি।
১৪ দলীয় জোট আছে, থাকবে: একজন সাংবাদিক বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চৌদ্দ দলীয় জোটের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না । এমনকি অনেকে বলছেন, ১৪ দল থাকবে না। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে জানতে চান সেই সাংবাদিক। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৪ দল তো অবশ্যই আছে। থাকবে না কেন? ১৪ দলীয় জোট না থাকার প্রশ্নই আসে না। তাদের সাথে আমাদের সব সময়ই যোগাযোগ আছে। যোগাযোগ নেই তা তো না। এখন দু-চারজন বিক্ষিপ্তভাবে কী বলছে আমি জানি না। আমাদের যিনি সমন্বয় করেন, আমির হোসেন আমু সাহেবের ওপর দায়িত্ব দেওয়া আছে দলের পক্ষ থেকে। তিনি যোগাযোগ রাখেন। তাছাড়া অনেকের সাথে আমার নিজেরও যোগাযোগ আছে। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক সবার সাথে যোগাযোগ রাখেন। যিনি সমন্বয়কারী তার সাথে তো যোগাযোগ আছেই। শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচনে ১৪ দলের অনেকে প্রার্থী দিয়েছিল, নির্বাচন করেছে, আর নির্বাচনে জেতা না জেতা আলাদা কথা, কিন্তু আমাদের এই জোট থাকবে। এটুকু বলতে পারি, জোট শেষ হয়ে গেছে কে বলল?’ শিগগিরই ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কার্যনির্বাহী বৈঠক করেছি, আমাদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করব এবং আমি ১৪ দলের সাথেও বসব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে উন্নয়নটা চোখে দেখলেও কেউ কেউ দেখেন না। উন্নয়নটা তারা নাও দেখতে পারেন, কারণ তাদের হয়তো উন্নয়নের ফর্মুলাটা ভিন্ন আর আমার উন্নয়নটা হচ্ছে আমার গ্রামের মানুষ দু’বেলা পেট ভরে খাবে, তাদের একটু বাসস্থান হবে, চিকিৎসা পাবে, শিক্ষা পাবে ও জীবন মান উন্নত হবে। শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের তো কিছু লোক রয়েছে, যারা সবসময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কানভারী করছে। তারা অনেক জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবী এবং তারা যখন সারাক্ষণ উল্টাপাল্টা বলতেই থাকবে, কিছুটা (বিদেশিরা) তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার দেশের মানুষইতো অনেকে প্রভাবিত হয়ে যায় আর বিদেশীরা তো হবেই। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু এসব কথায় প্রভাবিত হয় না। তারা কিন্তু ঠিক আছে। তাদের একটা আত্মবিশ্বাস আছে। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত আমরা করেছি।
হিটস্ট্রোক বাড়ছে, প্রকৃতির সঙ্গে তো কিছু বলার নেই: প্রধানমন্ত্রী গরমে সকলকে সচেতনতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন এবং তাঁর দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মস‚চি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। অবস্থা বুঝে যখন যেটা করার দরকার সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিচ্ছি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গরম নতুন নয়। তবে যেভাবে গরম বাড়ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। নিরাপদে থাকতে হবে, প্রচুর পানি খেতে হবে। কেননা হিটস্ট্রোক বাড়ছে। প্রকৃতির সঙ্গে তো কিছু বলার নেই। দেশে বন্যা হতে পারে৷ সেসব মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন বড় আকারে: আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর প‚র্তি উপলক্ষে এবার বড় আকারে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের পঁচাত্তর বছর উদযাপন করব খুব ব্যাপকভাবে। সেখানে আমরা আলোচনা করছি, বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা দেখব, কোন কোন দেশকে আমরা আমন্ত্রণ জানাতে পারি বা কারা আসতে পারে সেটাও আমাদের আলাপ আলোচনায় আছে। সেই বিষয়েও আমরা কর্মস‚চি নিচ্ছি। আমরা বিভিন্ন উপ কমিটি করে দিচ্ছি। আরও সুন্দরভাবে যাতে আমরা সব করতে পারি। কারণ আমাদের দল উপমহাদেশে একটা বড় দল, যেটা ৭৫ বছর উদযাপন করছে, এটা তো কম কথা না।’
পণ্যের একটু দাম বাড়লেই বড় করে গণমাধ্যমে প্রচার, এটা ঠিক না: প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবৈধ মজুতদারদের বিষয়টা সরকারের নজরে আছে। কিছু আছে চক্রান্ত, কিছু আছে অধিক মুনাফার লোভ। নির্দিষ্ট বেতনে চলা মানুষ কষ্টে আছে এটা ঠিক। তবে পণ্যের দাম একটু বাড়লেই, অনেক বড় করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, এটা ঠিক না। কেননা কমবেশি বিশ্বের সব দেশেই এখন মুদ্রাস্ফীতি চলছে।
নিজের সমবায় কৃষির মডেল সারাদেশে ছড়ানোর ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর: গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় নিজের গ্রামে সমবায় পদ্ধতিতে যে চাষাবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করছেন, তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার আগ্রহের কথা বলেছেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, সমবায় পদ্ধতিতে চাষ করলে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে, কমবে খরচ। অনাবাদি জমির পরিমাণও কমে আসবে। শেখ হাসিনা বলেন, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতায় তিনি একটি সমিতি করেছেন। তিনি ওই সমিতির উপদেষ্টা। নিজেদের ৯ বিঘা জমিও দিয়েছেন সমবায়ের আওতায় চাষাবাদের জন্য। সমিতির আওতায় যুক্ত হয়েছে মাছ চাষ। তিনি বলেন, অনেক অনাবাদি যদি চাষাবাদের আওতায় চলে আসছে। আমি যখন করলাম, আশেপাশের কৃষকরাও উৎসাহিত হল। তারাও কিন্তু নিজেরা চাষ শুরু করে দিয়েছে। নিজেরাই আবার নিজেদের জমি পরিষ্কার করেছে। আমাদের ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দুটি মেশিন আমি কিনে দিয়েছি সেখানে। কার জমি কতটুকু, ফসল বিক্রি করে সে অনুযায়ী টাকাটা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। নিচু জমিতে চাষের মাছ বিক্রি করে পাওয়া আট লাখ মালিকদের মধ্যে বণ্টন করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মাছ বিক্রি করে ৮ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। কৃষাণ-কৃষাণি যারা শ্রম দিয়েছে, তা ভাগ পেয়েছে। আমি আমার ভাগে এক লাখ টাকা পেয়েছি। আমি নিজের এলাকায় করেছি। এটা করে আমি মডেল হিসাবে দাঁড় করাব।
সহযোগিতার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হলো থাইল্যান্ডের সঙ্গে: থাইল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলতে পারি-কী পেলাম, কী পেলাম না সেটা বড় কথা না। সহযোগিতা পাওয়ার এবং সার্বিক উন্নয়নের নতুন দুয়ার খুলে গেলো। সেখানে ভালো সুযোগ সৃষ্টি হলো। আমি সব সময় দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ প‚র্ব এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগিতা, যোগাযোগ এবং মতবিনিময়, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ সার্বিকভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বন্ধুত্বটা গুরুত্বপ‚র্ণ। কাজেই এখানে বলব সরকার গঠনের পর এইবার প্রথম বিদেশ সফর করলাম থাইল্যান্ডে। বলতে গেলে ঘরের কাছের পড়শী দেশ। আমি সবসময় বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেই। থাইল্যান্ড কিন্তু খাদ্য, ফসল, ফল উৎপাদনে অনেক গবেষণা ও উৎকর্ষতা আছে। এইসব ক্ষেত্রে মতবিনিময় করছি। গবেষণা কিভাবে দুইদেশ ভাগাভাগি করতে পারি, অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করতে পারি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীরা সহজে সেখানে যেতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সহজে পণ্য রফতানি-আমদানি সহজভাবে করতে পারবো। ব্যবসা-বাণিজ্য, থাইল্যান্ড যেহেতু পর্যটনক্ষেত্রে অগ্রগামী সেই অভিজ্ঞতাটাও আমরা নিতে পারি। সেখানে বিনিয়োগ করতে পারবে, আমরা জায়গাও দিতে পারবো। পাশাপাশি আমাদের যে ৮০ মাইল লম্বা বালুকাময় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত রয়েছে, সেখানেও বিনিয়োগ করতে আহŸান জানিয়েছি। সেখানে জায়গা চাইলে আমরা দেবো। এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যা ভবিষ্যতে আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগবে। থাইল্যান্ড আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং এখন বিমসটেকের সভাপতি। বিমসটেকটা আমরাই প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে আছি। আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতাটা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘করোনা পরবর্তী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হওয়া দরকার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মতবিনিময় করে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করে দেশের মানুষের কল্যাণ করতে পারি সেটাকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। এটাই বড় প্রাপ্তি বলে মনে করি।’রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়েও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি মিয়ানমারের বিষয়টা গভীরভাবে দেখবেন এবং প্রত্যাবাসনের জন্য যেটা করার তা করবেন।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামান, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ।