আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশে একেবারেই রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া যারা তারা; আর কিছু আছে বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা অনবরত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গীবত গাচ্ছে। দেশবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এদেশের অতি বাম, অতি ডান সবই এখন এক হয়ে গেছে। এটা কীভাবে হলো আমি জানি না। এই দুই মেরু এক হয়ে সরকার উৎখাতে কাজ করছে। তাদের মুখ থেকে সারাক্ষণ শুনি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তবে আমাদের অপরাধটা কী? বাংলাদেশ তো পেছাচ্ছে না। এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? যে যাই বলুক, শত্রæর মুখে ছাই দিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সূচনা বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজের চেহারা আয়নায় না দেখে, মানবাধিকার নিয়ে বাংলাদেশকে সবক দেয়। মার্কিন কোনো পুলিশের গায়ে কোনো রাজনৈতিক দল হাত তুললে, কী করতো সেখানকার পুলিশ? কদিন আগে ফিলিস্তিনে যুদ্ধের বিরোধীতা করায় সাধারণ মানুষের আন্দোলনে কি জুলুমটাই না করলো আমেরিকার পুলিশ। এটা তো মানবাধিকার লঙ্ঘন। এর জবাব কী? প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ঘরে ঢুকে আমাদের বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। মানবাধিকার সংস্থা এবং যারা আমাদের স্যাংশনস দেয়, তারা এর কী জবাব দেবে? আমি এর জবাব চাই। তিনি বলেন, এই দেশে মানবাধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। কথা বলার স্বাধীনতা কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার কতটুকু আছে সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশের ওপর মানবাধিকারের রিপোর্ট লেখে, নিজেদের আয়নায় চেহারা দেখে না, এটাই প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনে পুলিশি হামলার ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা যেভাবে আচরণ করে, সেভাবে আমাদের পুলিশ তো করেনি। ধৈর্যের পরিচয় দিতে গিয়ে উল্টো বিএনপির হাতে মার খেয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাকে হত্যা করবে, আমাদের ক্ষমতা থেকে হটাবে, আবার ১৫ আগস্ট ঘটাবে। তা আমরা অনবরত শুনেই আসছি।’ বাংলাদেশের পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দেয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৩-১৪ সালে পুলিশের ওপর হামলা সবাই দেখেছে। বেশি দ‚র যেতে হবে না-গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি যে ঘটনা ঘটালো, মানুষ হত্যা, রেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারা। সেগুলো তো তারা করেছে। বেচারা পুলিশদের দোষটা কই? তাদের ওপর লাঠিসোঁটা দিয়ে হামলা তো কল্পনা করা যায় না। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন, হাসপাতালে আক্রমণ। ইহুদিরা যেভাবে ফিলিস্তিনে ঘটিয়েছে, ঠিক তেমনই বিএনপি বাংলাদেশে ঘটিয়েছে। এটা ভোলা ঠিক না।’
আমাদের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করার কে তারা: বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমাদের অধীনে তারা নির্বাচন করবে না। আমাদের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করার কে তারা? যাদের জন্মই হয়েছে ভোট চুরির মধ্য দিয়ে তারা আবার প্রশ্ন করে কীভাবে? জনগণ বলুক। দেশের মানুষ তো ভোট দিয়েছে, দেশের মানুষ তো শান্তিপ‚র্ণ ভোট দিতে পেরে খুশি। হ্যাঁ, এলাকায় এলাকায় কিছু সমস্যা হয়, এটা স্থানীয়ভাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে, নির্বাচনের ইতিহাস যদি আমরা দেখি অন্তত বলবো- যে নির্বাচন হয়ে গেলো, এইভাবে সুষ্ঠুভাবে একটা নির্বাচন কবে হয়েছে বাংলাদেশে?
শেখ হাসিনা বলেন, করোনার সময় আমরা বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিয়েছি। পৃথিবীর ধনী দেশগুলো দেয়নি, কিন্তু বাংলাদেশ দিয়েছে। টেস্ট আমরা বিনা পয়সায় করেছি, কোনও ধনী দেশও করেনি। আমরা দুই হাতে পানির মতো টাকা খরচ করে মানুষকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিয়েছি। খুব কম দেশই সেটা করতে পেরেছে। আমরা সেখানে সাফল্য অর্জন করেছি। তিনি বলেন, মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়েছি, শিশু মৃত্যুর হার কমিয়েছি। স্বাক্ষরতার হার বাড়িয়েছি। মানুষের আয়ুস্কাল বৃদ্ধি করেছি। মানুষের ঘরের কাছে চিকিৎসাসেবা নিয়ে গেছি। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি আছে। সব দিক থেকেই তো বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। পিছিয়ে আছি কোথায় আমরা? মাথাপিছু আয় আমরা বৃদ্ধি করেছি, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার অতিমারি, এরপর আসে ইউক্রেন যুদ্ধ। স্যাংশন-কাউন্টার স্যাংশন। সারা বিশ্বব্যাপী ম‚দ্রাস্ফীতি। এসব সমস্যার কারণেই কিন্তু আমরা নয়, সারা পৃথিবী, এমনকি উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। তারপরও আমরা আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছি। ২০০৮ সালর নির্বাচনি ইশতেহারে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা এক ধাপ ওপরে তুলবো। রূপকল্প ২০২১ আমরা ঘোষণা দেই, দিন বদলের সনদ আমরা ঘোষণা দেই। আজ দিন বদল ঘটেছে। তিনি বলেন, সব সময় আমরা লক্ষ্য রেখেছি তৃণম‚লের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করা। আজ কেউ বলতে পারছে না যে গ্রামে দারিদ্য আছে। এখন বলে- শহরে দারিদ্র্য। এখন অদ্ভুত এক হিসাব হয়ে গেছে, দারিদ্রের হার শহরে বেড়ে গেছে, গ্রামে না। অথচ এক সময় গ্রামের মানুষ একবেলা ভাত খেতে পেতো না। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। রোগের চিকিৎসা পেতো না। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। আমাদের উন্নয়নে তৃণম‚ল মানুষের দিকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পিতভাবে এগিয়েছি। ইতিমধ্যে কয়েকটি জেলা-উপজেলা গৃহহীন, ভ‚মিহীন মুক্ত ঘোষণা দিয়েছি। অল্প কিছু বাকি আছে, সেগুলোও শিগগিরই হয়ে যাবে। বাংলাদেশের কোনও মানুষই ঠিকানাবিহীন থাকবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগকে সবসময় ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই পথ চলতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশ ও মানুষের ওপর আস্থা রেখেই দেশ চালায়। তবে কিছু রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চোখে কিছুই ভালো লাগে না। পদ্মা সেতুতে ইতিমধ্যেই ১৫০০ কোটি টাকা টোল উঠেছে। এটাই তো প্রাপ্তি। বাংলাদেশ যে পারে এটাই তার প্রমাণ। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করেছে। বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ক্ষমতায় বসে লুটপাট করতে পারছে না বলেই সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় নেমেছে বিএনপি। এটি এমন একটি দল, যাদের কোনো মাথামুন্ডু নেই। তারা শুধু পারে অনলাইনে নির্দেশনা দিতে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি যে অপকর্ম করেছে, তা মানুষের ভুলে যাওয়া উচিত না। শেখ হাসিনা বলেন, ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসা দলের কাছে আজ গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়। যারা ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তারা কেনো বুঝছে না দেশবাসী এই নির্বাচনে ভোট দিতে পেরে খুশি। জনগণের আস্থা আওয়ামী লীগ পেয়েছে, কারণ মানুষ বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগ তাদের উপকার করে। জনগণের আস্থা-বিশ্বাসই আওয়ামী লীগের ম‚ল শক্তি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ দেশের মানুষের দিন বদল হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়া যাবে। প্রচন্ড গরমে দেশবাসীকে সাবধানে থাকার আহŸান জানিয়ে তিনি বলেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় গরম ছড়িয়ে পড়ছে। শিগগিরই বৃষ্টি হবে বলে আশা করছি। পহেলা আষাড় থেকে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ চালিয়ে যেতে হবে বলেও জানান শেখ হাসিনা।
চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে হারানো হয়েছিল: বেশি দ‚র নয়, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনেও চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে হারানো হয়েছিল দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, পারসেন্টিজে ভোট আমাদের বেশি ছিল। আমরা সিট পাইনি। কারণ আমি রাজি হইনি আমার দেশের গ্যাস অন্য দেশের কাছে বেচতে। আজ গ্যাসের জন্য হাহাকার। আমরা যদি তখন রাজি হতাম বা গ্যাস বিক্রি করা শুরু করতাম তাহলে কী অবস্থা হতো? আমাদের কোনও ইন্ডাস্ট্রি চলতো? ফার্টিলাইজার ফেক্টরি চলতো? বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়তো? হতো না। শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া কিন্তু সেই মুচলেকা দিয়েছিল। সে কিন্তু কথা দিয়েছিল ক্ষমতায় গেলে গ্যাস বিক্রি করবে। আমি শুধু একুটু বলেছিলাম- আল্লাহ তায়ালা জন বুঝে ধন দেন। খালেদা জিয়া কথা দিয়েছিলেন গ্যাস বিক্রি করবে, ওই গ্যাস পায়ই না। তাদের আমলে ক‚প খনন করে গ্যাস পায়নি। ওদিকে তাদের দৃষ্টিও ছিল না। ক্ষমতায় যাবে, লুটপাট করবে, পয়সা বানাবে, হাওয়া ভবন খুলে খাওয়া খাবে- এটাই ছিল তাদের মাথায়, এটাই তারা করেছে। সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটে শুরু হওয়া সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। রাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। বৈঠক থেকে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে সারাদেশে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। এছাড়া দল সুসংগঠিত করার বিষয়েও নির্দেশনা আসবে বলে জানা গেছে।