যার আপন হাসিতে উদ্ভাসিত হয়েছে অসীমের রঙ্গমঞ্চ, আঞ্চলিক ভাষার সেরা অভিনেতাদের একজনও তিনি। অভিনয় জগতে উজ্জ্বল চরিত্রের কারণে সবার প্রিয় ছিলেন ওয়ালিউল হক রুমি। নিরবে নিভৃতে চলে গেলেন তিনি। গতকাল সোমবার ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন মঞ্চ ও টেলিভিশন জগতে সবার প্রিয় রুমি ভাই। গত এক মাস ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে গেলেন। ভারতেও চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে থেকে দেশে ফিরে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করেছেন।
মাসখানেক আগে হঠাৎ করেই অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, তিনি দুরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেই থেকে ছিলেন চিকিৎসাধীন। সর্বশেষ রাজধানীর ধানমন্ডি শংকরে ইবনে সিনা হাসপাতালের স্ট্রোক আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। ভোরের দিকে চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দেন, তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সবসময় হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত এই মানুষটি নিজের অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন দেশের মানুষকে।
রুমির মৃত্যুর খবরে নাট্যাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। টিভি নাটকের সহশিল্পীদের অনেকে রুমিকে নিয়ে ফেসবুকে স্মৃতিচারণা করছেন। জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী লিখেছেন, ‘ভেবেছিলাম একটু সুস্থ্য হয়ে ওঠেন, আপনাকে দেখতে যাব। আর দেখা হলো না। এ কেমন বিদায় রুমি ভাই। নিয়তির কাছে সকলেই হার মানে, মানতে হয়। তবে আপনি একটু তাড়াতাড়িই চলে গেলেন। অন্যলোকে শান্তিতে থাকুন রুমি ভাই। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’ আরেক অভিনেতা আরিফিন শুভ লিখেছেন, ‘রুমি ভাই, আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, মনে, প্রাণে।’
রুমির সঙ্গে তোলা একটি ছবি ফেসবুকে দিয়ে অভিনেত্রী শামীমা তুষ্টি লিখেছেন, ‘রুমি ভাই, এই চলে যাওয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর নাই। ভালো থেকো ভাই ওপারে।’ অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী লিখেছেন, ‘রুমি ভাই বিদায়। আমার পরিচালনায় প্রথম ধারাবাহিক “সেলাই পরিবার” নাটকের সময়টা মনে হচ্ছে খুব। আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসিব করুন।’রুমির মৃত্যুতে জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, আনিসুর রহমান মিলন, রাশেদ মামুন অপুসহ আরও অনেকে সামাজিক মাধ্যমে শোক জানিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে রুমির অভিনয়ের শুরু থিয়েটার বেইলি রোডের ‘এখনো ক্রীতদাস’ নাটকের মধ্য দিয়ে। একই বছর ‘কোন কাননের ফুল’ নাটকের মাধ্যমে ছোট পর্দায় অভিষেক হয় তার। বর্তমানে তার অভিনীত ‘বকুলপুর’ নামের একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক দীপ্ত টিভিতে প্রচার হচ্ছে। টেলিভিশনের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন সিনেমাতেও। ২০০৯ সালে ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতি’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন রুমি। বরগুনায় জন্ম রুমি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বেশি অভিনয় করে আসছিলেন। এ ভাষাতেই তিনি দর্শকদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেনও।
রুমির বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক। মা হামিদা হক। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন রুমি। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে গেছেন। অভিনয়ে তিন দশকের বেশি সময় পার করেছেন রুমি। দীর্ঘ এ পথচলায় অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটক ও সিনেমায়। অভিনয়নৈপুণ্য দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে গেছেন। পর্দায় তার উপস্থিতি বাড়তি আনন্দ দিয়েছে দর্শকদের। ২০০৯ সালে ‘দরিয়াপাড়ের দৌলতি’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন রুমি। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘সাজেশন সেলিম’, ‘বোকাসোকা তিনজন’, ‘মেকআপ ম্যান’, ‘ঢাকা টু বরিশাল’, ‘ঢাকা মেট্রো লাভ’, ‘বাপ-বেটা দৌড়ের উপর’, ‘আমেরিকান সাহেব’, ‘জার্নি বাই বাস’, ‘বাকির নাম ফাঁকি’, ‘যমজ-৫ ’, ‘যমজ-৬ ’, ‘যমজ-৭ ’, ‘যমজ-৮’, ‘যমজ-৯ ’, ‘যমজ-১০ ’, ‘রতনে রতন চিনে’, ‘২০০ কদবেলী ইত্যাদি’, ‘সোনার শিকল’, ‘কমেডি ৪২০ ’, ‘প্রেসিডেন্ট সিরাজউদ্দৌলা’, ‘আকাশ চুরি’, ‘চৈতা পাগল’, ‘জীবনের অলিগলি’, ‘মেঘে ঢাকা শহর’ ইত্যাদি।
গতকাল সকাল ৯টায় রাজধানীর শহীদবাগ এলাকায় প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ গ্রামের বাড়ি বরগুনা নেওয়া হয়। সেখানে মায়ের কবরের পাশে চিরঘুমে থাকবেন সবার প্রিয় রুমি ভাই।