চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাণিজ্য ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকা অফিসে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে ব্যাংক একীভূতকরণের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।
উল্লেখ্য, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এবছর এই হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দিল বিশ্বব্যাংক। যদিও পরের বছর কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হবার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুল্লায়ে সেক বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌল ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ায় অতীতের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সহায়তা করেছে। আর্থিক ও মুদ্রানীতির সংস্কারের নেওয়া পদক্ষেপ দ্রæত বাস্তবায়ন করতে পারলে তা প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চার ও সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়ক হবে।
ব্যাংক একীভূত (মার্জার) করার চলমান পদক্ষেপে সতর্ক থাকার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয় ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সম্পদের মান ও নীতিমালার আলোকে ব্যাংক একীভূত হওয়া উচিত। একীভূত করার আগে দুর্বল ব্যাংকের সম্পদের মান নিরীক্ষা করা এবং একীভূত করার নীতিমালা হালনাগাদের পরামর্শ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না হলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে। রিজার্ভ বাড়াতে ফের মুদ্রানীতি সংস্কার এবং বিনিময় হার একটিতে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। তাদের যুক্তি, এ পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সহায়ক হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরি পোশাক খাতের বাজার বাড়ছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণের উদ্যোগ ও আর্থিক খাতের সংস্কার মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতির সহনশীলতা বৃদ্ধি করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণের উচ্চ হারসহ দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকিং খাত চাপের মুখে রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও মন্থর হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগে মন্দাবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের উচ্চ হারসহ দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে এই খাত চাপের মুখে আছে।
তবে কোভিড-১৯ মহামারি থেকে প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি, লেনদেন ভারসাম্যে ধারাবাহিক ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে মহামারি–পরবর্তী পুনরুদ্ধার ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে; সেই সঙ্গে তারল্যের রাশ টেনে ধরা, ক্রমবর্ধমান সুদের হার, আমদানি বিধিনিষেধ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ব্যাহত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ; পরের অর্থবছরে তা অনেকটা কমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এ বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রানজিস্কা ওনসর্গ বলেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশের মত জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আরো ১৬ শতাংশ বেশি আর্থিক সুবিধা পাবে।