বাজারের অস্বাস্থ্যকর ইফতারি বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুনি, চপ, ছোলা, জিলাপি, নিমোকপোড়া, পাকোড়াÑসব খাবারই ডুবো তেলে ভাজা। এছাড়া মুড়িতে ইউরিয়া, জিলাপি-বুন্দিয়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে কাপড়ের রঙ। অথচ এসব খাবার ছাড়া যেন ইফতারির ষোলকলা পূর্ণ হয় না। রমজান মাসে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই পাড়া-মহল্লায় রাস্তার পাশে বসে এসব মৌসুমি ইফতারির দোকান।
বড় বড় হোটেল রেষ্টুরেন্টের সামনের অংশে থরে থরে সাজানো থাকে এসব লোভনীয় ইফতারী। আর সারাদিনে না খেয়ে থাকা রোজাদার ক্রেতারা একটু মুখরোচক ঝাল ঝাল মুচমুচে খাবার খেতে দেদারচে কিনে নেন এসব খাবার। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, রং দিয়ে, ডুবো তোলে, পোড়া তেলে ভাজা এসব খাবার শরীরের জন্যে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফ্যাটিলিভারসহ নানা স্বাস্থ্য ঝুকি।
রাজধানীর শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, তাজমহল রোড, সলিমউল্লাহ রোড, নুরজাহান রোড, কারওয়ান বাজার, ঘুরে দেখা যায়, চৌকি কিংবা বাঁশের ডালাতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রকমারি ইফতার। যার সবগুলোই ডুবো তেলে ভাজা। কিছু হোটেল- রেষ্টুরেন্টের ইফতার প্লাষ্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা হলেও বেশিরভাগ ইফতারি বিক্রয় হচ্ছে খোলা অবস্থায়। অনেকে আবার কেরোসিনের চুলো জ্বালিয়ে ভাজছে জিলাপি, পাকড়াসহ ইফতারির বিভিন্ন আইটেম।
শ্যামলী-২ সম্বর সড়কের মাথায় ইফতার কিনতে আসা নূরে আলম বলেন, আমরা তো মেসে থাকি তাই এসব বাইরের খাবার আমাদের একমাত্র ভরসা। স্বাস্থ্যঝুকি আছে জেনেও এসব খাবার আমরা কিনে খাই। অন্য আরেকজন ক্রেতা রাসেল বলেন, উনারা তো বাধ্য হয়ে খায়, কিন্তু আমার বাসার বাচ্চারা বাসারটা খাবে না, খাবে বাজারের কেনাটা। এতে পয়সাও খরচ হচ্ছে বেশি এবং স্বাস্থ্যেরও বারটা বাজছে, কিন্তু বাচ্চাদের মানাতে পারছি না। তিনি বলেন, আমরা আসলে সচেতন মানুষ নই। এদিকে গৃহিনী আয়েশা আমিন বলেন, বাঙালীদের খাবারে ভাজা-পোড়া খাবার এমন ভাবে মিশে গেছে যে, পেয়াজু, বেগুণী, আলুনি ছাড়া যেন ইফতার পূর্ণতা পায় না। যতই অন্য স্বাস্থ্যকর খাবার ইফতারিতে রাখি না কেনো, ওসব ছাড়া যেন ইফতার অপূর্ণ।
পুষ্টিবিদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে মুড়ির। সেই মুড়িকে সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। মুড়ি বড় বড় দানায় পরিণত করতে ব্যবহার হয় ইউরিয়া সার। মুড়িতে মাশানো এই ক্ষতিকর উপাদান পেটে গেলে আলসার, মানব দেহে রক্তের শ্বেতকনিকা, হিমোগেøাবিনের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। জিলাপি দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখতে তেলের সঙ্গে মবিল মেশানো হচ্ছে। ভাজাপোড়ায় ব্যবহৃত তেল কড়াই থেকে তিন-চার দিনেও ফেলা হচ্ছে না। এইসব দিয়ে তৈরি খাবার পেটের পীড়া, কিডনি ও যকৃত সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কেমিক্যাল রঙ। কম খরচে বেশি লাভের আশায় এক শ্রেণীর ইফতার বিক্রেতা ‘ফুড কালার’র পরিবর্তে ব্যবহার করে কাপড়ে ব্যবহৃত রঙ।
জানা যায়, এক কেজি টেক্সটাইল কালারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ টাকা। সেখানে এক কেজি ফুড কালারের মূল্য প্রায় ১০ হাজার টাকা। খাদ্যে মেশানো কাপড়ের রঙ স্বল্প সময়ে কিডনি ও লিভারে আক্রান্ত করে, দীর্ঘমেয়াদে মানবদেহে ক্যান্সার মত রোগ সৃষ্টি করে। মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ভেজাল চিনি। এর রাসায়নিক নাম সোডিয়াম সাইক্লামেট। মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাকারিন, সুকরালেস ইত্যাদি। জিলাপিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল সামগ্রীর পাশাপাশি ‘বাসন্তী রঙ’ ব্যবহার করা হয়। ফলে সাধারণ জিলাপির চেয়ে এসব জিলাপি বেশি উজ্জ্বল দেখা যায়। হালিমে মাংসের দেখা মেলে না, তবে আগের দিনের অবিক্রিত ডাল ও মাংসের উচ্ছিষ্ট থাকে ঠিকই।
চিকিৎসকরা বলছেন, সারাদিন রোজা রেখে অস্বাস্থ্যকর তেলেভাজা ইফতারি হৃদরোগ-স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। একই তেল দিনের পর দিন ব্যবহার করে তৈরি খাবার নিয়মিত গ্রহণে ফ্যাটিলিভার থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তারা বরছেন, ধর্মীয়ভাবে এ মাসে সংযমের কথা বলা হলেও, এ মাসেই অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা হচ্ছে। আর ইফতারির নামে যা খাওয়া হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমাদের দেশে ইফতার মানেই ভাজাপোড়া, এসব তৈলাক্ত জিনিস বেশি খাওয়া ক্ষতিকর। বিশেষ করে হার্টের রোগী, ডায়াবেটিসের রোগীর জন্যে খুবই ক্ষতিকর।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ এর ২ ধারা অনুযায়ী ‘নিরাপদ খাদ্য’ বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্য বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এই আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্য ভেজাল মিশিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।
অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ ক্রমান্বয়ে অসুখ হওয়া এমনকি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। খাবারগুলো দৃষ্টিনন্দন করার জন্য যে রংগুলো মেশানো হচ্ছে সে রংগুলো শরীরে নানাভাবে ক্ষতি করছে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। এই বিষ মানুষের শরীরে ঢুকে জ্বিনের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হচ্ছে। ক্যান্সারের মতো মারাত্বক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, রমজান মাসে শরবত মানুষের খুব প্রিয় পানীয়। বাজারে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শরবতগুলোতে কী রঙ মেশানো হয় তা আপনার জানেন। এসব রং বেশির ভাগই খাবার যোগ্য রঙ নয়। এসব রঙ মানুষের শ্বাস কষ্টের সমস্যা বাড়ায়, চোখের সমস্যা বাড়ায় এবং শরীরের ত্বকের ক্ষতি করে। এছাড়া এই রঙ কিডনি ড্যামেজ করে ফেলে। খাবারকে মজাদার করার জন্য যে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয় এটাও নানাভাবে মানুষের জীনকে বাধাগ্রস্থ করছে। তিনি আরও বলেন, রাস্তার পাশে বসে যে ইফতারি তৈরি করছে ক্রমাগত বায়ুদূষণের কারণে এই খাবার গুলোতে ধূলাবালি পড়ছে এবং খাবার দূষিত হচ্ছে। যারা এই খাবারগুলো তৈরি করছে তারা হাত পরিস্কার করছে না, হাত গøাভস পড়ছে না। ফলে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের কারণে।