প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ। তবু আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশের অভ্যন্তরে কিছু লোক খুন-খারাবি, অগ্নিসন্ত্রাস, অনেক কিছু করে থাকে। তাদের সুমতি হোক। একটা শান্তিপ‚র্ণ পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলে একটি দেশ যে এগিয়ে যেতে পারে উন্নতি করতে পারে; তার প্রমাণ আমরা করেছি। আজ বাংলাদেশকে অন্তত বিশ্বে একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এই যাত্রা অব্যাহত থাকুক। আমাদের দেশের মানুষ বিশ্বে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে চলুক সেটাই আমরা চাই।’
গতকাল সোমবার সকালে জাতীয় পর্যায়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তির হাতে দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৪’ প্রদানকালে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য যারা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী নীরবে নিভৃতে থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পুরস্কারে সম্মানিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন, যাতে অন্যরা অনুপ্রাণিত হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি যারা বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে ও অন্যান্য এলাকায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে চলেছেন, তাদের খুঁজে বের করে পুরষ্কার দিয়ে সম্মানিত করার জন্য। তাদের জন্য নয়, বরং জনগণের কল্যাণের জন্য। কারণ, তারা কখনই সামনে আসেন না বা আসতে চান না। নিজস্ব উদ্যোগে বা স্ব-প্রণোদিত হয়ে যারা মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন অবদান রেখে যাচ্ছেন তাদেরকে পুরস্কৃত করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় কথা।’ তিনি বলেন, ‘এই পুরস্কার প্রাপ্তির ফলে মানুষের জন্য কাজ করা ও দেশের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে আরো অনেকে অনুপ্রাণিত হবেন এবং দেশের কল্যাণে কাজ করবেন, সেটাই আমরা আশা করি।’
প্রধানমন্ত্রী বিগত ১৫ বছর দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য তুলে ধরে বলেন, অন্তত এইটুকু দাবি করতে পারি বাংলাদেশের সেই হারানো গৌরব আমরা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর যে মর্যাদা বাংলাদেশ অর্জন করেছিল এবং ‘৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যা হারিয়ে যায়। তিনি বলেন, জাতির পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় রেখে যান। সেখান থেকে আমরা আরো এক ধাপ উত্তরণ ঘটিয়ে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা এনে দিতে পেরেছি। ২০২৬ সাল থেকে যা কার্যকর হবে। আজ জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। ‘জয় বাংলা’ আবার ফিরে এসে এখন আমাদের জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ইতিহাস বিকৃতির যত চক্রান্তই হোক না কেন আজকের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়, বুঝতে চায়। সেই প্রেরণা নিয়েই সামনের দিকে চলতে চায় এবং জীবনকে গড়ে তুলতে চায়। আর এটাই আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় আশার বাণী।
এর আগে গত ১৫ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই বছরের স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। পুরস্কার প্রাপ্তরা হচ্ছেন: স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কাজী আব্দুস সাত্তার বীর প্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. ফজলুল হক (মরণোত্তর) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবু নঈম মো. নজিব উদ্দীন খাঁন (খুররম) (মরণোত্তর), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ড. মোবারক আহমদ খান, চিকিৎসা বিদ্যায় ডা. হরিশংকর দাশ, সংস্কৃতিতে মোহাম্মদ রফিক উজ্জামান, ক্রীড়ায় ফিরোজা খাতুন, সমাজ বা জনসেবায় অরন্য চিরান, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী ও এসএম আব্রাহাম লিংকন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন পুরস্কার বিতরণী পর্বটি সঞ্চালনা করেন এবং পুরস্কার বিজয়ীদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরেন। স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৪ বিজয়ীদের পক্ষে মোহাম্মদ রফিক উজ্জামান অনুষ্ঠানে নিজস্ব অনুভ‚তি ব্যক্ত করেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, বিচারপতি, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিদেশি ক‚টনীতিক, উর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিক লেখকসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কোভিড-১৯ পরবর্তী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে নিষেধাঞ্জা ও পাল্টা নিষেধাঞ্জায় বিশ^ব্যাপী খাদ্য পণ্য ও পণ্য পরিবহনের ম‚ল্যবৃদ্ধিতে সৃষ্ট ম‚ল্যস্ফীতিতে কৃচ্ছতা সাধন এবং দলের নেতা-কর্মীসহ সামর্থ্যবানদের সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষের যাতে কোন কষ্ট না হয় সেজন্য আমরা এই রমজান মাসে মানুষের মাঝে বিনাম‚ল্যে খাদ্য বিতরণ করছি। আমরা ইফতার পার্টি বাদ দিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সকলকে আহ্বান করেছি ইফতার পার্টি না করে ইফতার সাধারণ মানুষের মাঝে আপনারা বন্টন করেন। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইফতার পার্টি করা বড় কথা নয়, মানুষকে দেওয়াই বড় কথা। কাজেই আমরা খাওয়ার বিষয়টা বাদ দিয়ে দেওয়ার দিকেই মনোযোগ দিয়েছি। মানুষের যাতে কোনো রকম কষ্ট না হয় সেদিকে আমরা লক্ষ রেখেছি। এই সময় ন্যায্যম‚ল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী প্রাপ্তিতে এক কোটি কার্ড করে দেওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের সেই কালরাতে গণহত্যার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সকল বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, ‘আর যারা সেই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রতি জাতির ঘৃণা প্রকাশ করছি।’ শেখ হাসিনা এসময় ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনকে ‘গণহত্যা’ উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। আমরা ফিলিস্তিনিদের সাথে আছি। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। কারণ যুদ্ধকালীন অবস্থা কী রকম হয় তা আমরা জানি, আমরা ভ‚ক্তভোগী। তিনি জাতির পিতার রেখে যাওয়া পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ এর উল্লেখ করে মিয়ানমারের ১০ লাখের অধিক জোরপ‚র্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রদান এবং প্রতিবেশির সঙ্গে সংঘাতে না জড়িয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিজ দেশে সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টার উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের কাছে সম্মানিত। কারণ তাঁরা জাতির পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে আমাদের বিজয় এনে দিয়েছিলেন। কাজেই তাদের সম্মান দেওয়া এবং আমাদের এই গৌরবটা যেন হারিয়ে না যায় আমরা তার ব্যবস্থা নিয়েছি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারদের সদস্যদের ভাতা, গৃহহীনদের জন্য বীর নিবাস তৈরিসহ তাঁর সরকার প্রদেয় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘দল মত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘের এসডিজি বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব লক্ষ্য স্থির করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ’ গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবো। স্বাধীনতার মাসে এটাই আমাদের প্রত্যয়। দেশবাসীকে স্বাধীনতা ও জাতিয় দিবসের শুভেচ্ছাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গঠনে আমার এগিয়ে যাব।’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে যে মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতায় এসেছিল, তারাও এ দেশে একাত্তরের মতই গণহত্যা চালিয়েছিল। আমাদের সেনা অফিসারদের একের পর এক হত্যা করা হয়েছে। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে এবং এরপরে নির্বাচনী প্রহসন, দল গঠন, দল ভাঙন। নানান ধরনের খেলা ২১টি বছর আমাদের ওপর চলেছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, এই বাংলাদেশের একটি মানুষও ভ‚মিহীন থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না, ঠিকানাবিহীন থাকবে না। প্রতি ঘরে ঘরে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। শিক্ষার হার বৃদ্ধি করেছি, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে এনেছি, উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। জাতিসংঘের এসডিজি বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব লক্ষ্য স্থির করে আমরা আগাচ্ছি। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। স্বাধীনতার মাসে এটাই আমাদের প্রত্যয়। স্বাধীনতার মাসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, গণহত্যায় জড়িতদের প্রতি ঘৃণা জানাই। আর যেন এরকম না হয়।