spot_img

পুরান ঢাকার প্রতি বাড়িতে কারখানা, ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা

পুরনো ঢাকার চকবাজারের পশ্চিম ইসলামবাগ এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনে লাগা আগুন গতকাল শনিবার ভোর ৬টার দিকে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর আগে রাত সোয়া ৩টার দিকে আগুনের সূত্রপাত। আগুন লাগা ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ছিল প্লাস্টিকের দানার গোডাউন। দ্বিতীয় তলা থেকেই সূত্রপাত হয় আগুনের। আর প্লাস্টিকের দানার কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
এদিকে একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা আর হতাহতের পরও চরিত্র বদলায়নি পুরান ঢাকার। বহাল তবিয়তে ঘিঞ্জি এলাকায় একইসঙ্গে চলছে রাসায়নিকের গুদাম, প্লাস্টিক কারখানা। সেই সঙ্গে মানুষের বসবাস। ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দিন পার করলেও শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না কারখানা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, দ্রæত ব্যবস্থা না নিলে সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপদ।
ফায়ার সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার বলেন, রাত সোয়া ৩টার দিকে সেখানে আগুন লাগে। আগুনের খবর পেয়ে রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে। পরপর আরও ৮টি ইউনিট যোগ দেয়। তবে কী কারণে আগুন লেগেছে, কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত প্রাথমিকভাবে তা কিছু জানাতে পারননি তিনি। এছাড়া এখন পর্যন্ত কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
গতকাল শনিবার দুপুরে ভবনটিতে সরেজমিনে দেখা যায়, তখনও বের হচ্ছে ধোঁয়া। প্লাস্টিক পোড়া গন্ধ পুরো এলাকাজুড়ে। পশ্চিম ইসলামবাগের নামাপাড়া এলাকায় শহীদুল ইসলাম বাবুল রোডে অবস্থিত চার তলা ভবনটির পুরোটাজুড়েই ছিল স্পন্সের স্যান্ডেল তৈরির কারখানা। ভবনটির নিচতলা ব্যবহার হতো জুতা ও খামারের শিট তৈরি করতে। আর দ্বিতীয় তলার একাংশে ছিল গোডাউন। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় রাখা হতো তৈরি জুতা এবং একটা অংশ ব্যবহৃত হতো প্যাকিজিংয়ের কাজে। তৃতীয় তলায় একটা অংশে শ্রমিকদের থাকার জায়গা।
ভবনটিতে দেখা যায়, আগুনে দ্বিতীয় তলায় প্লাস্টিক শিটের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে দ্বিতীয় তলার অপর একটি রুমে আগুন পৌঁছেনি। এছাড়া বাকি তলাগুলোতেও কোনও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। শ্রমিকরা দ্বিতীয় তলা থেকে প্লাস্টিক শিট বস্তায় ভরে অন্যত্র স্থানান্তরে কাজ করছিলেন। স্থানীয়রা জানান, ভবন ও কারখানার মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিল শহীদুল ইসলাম বাবুল। কারখানাটির নাম লৌহজং প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি। প্রায় ২০ বছর ধরে ভবনটিতে এই কারখানা চলে আসছে। কারাখানাটিতে মূলতো প্লাস্টিক রিসাইকেলিং-এর কাজ করা হয়। পুরোনো প্লাস্টিক গলিয়ে পরিণত করা হয় প্লাস্টিক দানায়। তা থেকে তৈরি করা হয় স্পন্সের স্যান্ডেল ও খামারের জন্য শিট। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে তা এখনও জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের ইনসিডেন্ট কমান্ডার উপপরিচালক ছালেহ উদ্দিন ঘটনাস্থলে বলেন, ‘এখনও আগুনের সূত্রপাত কীভাবে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত সে বিষয়ে কোনও তথ্য জানা যায়নি। তবে বিস্তারিত তদন্ত শেষে জানা যাবে আসলে কীভাবে আগুন লেগেছিল এবং কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।’
কারখানার কারিগর শুভ হোসেন আগুন লাগার বিষয়ে বলেন, ‘শুক্রবার ছুটি ছিল ছুটির আগে বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কথা। যেহেতু বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ ছিল তাহলে তো শর্ট সার্কিট হওয়ার কথা না। আর ভবনটিতে কেউ ছিল না। এখনও বুঝতে পারছি না কীভাবে আগুন লেগেছে।’ আর কারখানা মালিকের ছোটোভাই আব্দুল কুদ্দুস রানা বলেন, ‘ভবনটিতে রাতে কেউ ছিলে না। কীভাবে আগুন ধরেছে বুঝতে পারছি না। ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে এখনও হিসাব করা হয়নি। রাতে ভবনে কেউ ছিল না।’
তবে স্থানীয়রা জানান, রাতে অন্তত ২০-৩০ জন শ্রমিক থাকেন ভবনটিতে। অগ্নিকান্ডের সময়ও তারা ভবনে ছিলেন, পরে বের হয়ে আসেন। স্থানীয় বাসিন্দা জাবেদ হোসেন জানান, বিদ্যুৎ থেকে আগুন লাগতেও পারে। আবার রাতে মানুষ থাকে ফলে তাদের জ্বালানো কয়েল বা সিগারেট থেকেও আগুন ধরতে পারে।
ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা : ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে প্লাস্টিকের নানা পণ্য তৈরি অবশ্যই একটি সম্ভাবনাময় খাত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেমন তার কাজের পরিবেশ? সরেজমিনে কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, মালামালে ঠাসা জায়গা। আদতে কারখানা নাকি গুদাম ঘর- বুঝে ওঠা দুষ্কর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক পণ্য ও প্লাস্টিকের তৈরি কাঁচামালের ফাঁকে কোনোমতে চলছে মেশিন। নেই পা ফেলার সামান্য জায়গাও।
সিঁড়িসহ ওপরের তলায়ও থরে থরে সাজানো বস্তার স্তুপের ভিড়ে পা রাখা দায়। ছাদজুড়ে তৈরি পণ্যের গোডাউন, আবার তার পাশেই শ্রমিকদের থাকার ঘর। পুরো পুরান ঢাকাই যেন এখন পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাড়িতে এক বা একাধিক কারখানায়। যে যেভাবে পারছেন কারখানা চালাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘নিচে কারখানা, ওপরে মানুষের বসবাস’। একদিকে সরু রাস্তা, পানির উৎসের অভাব, অন্যদিকে বাড়ি বাড়ি কারখানা থাকাকে সম্পূর্ণ বেআইনি উল্লেখ করে দ্রæত শৃঙ্খলা ফেরানোর পরামর্শ ফায়ার সার্ভিসের।
লালবাগ ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. মাস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখানে বিদ্যুতের লাইনগুলোও এলোমেলোভাব আছে। এগুলো গুছিয়ে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। যত্রতত্র কারখানা স্থাপন বন্ধে বাড়িওয়ালাদেরও লোভ সংবরণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ