spot_img

লাইন মেরামত না করায় বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা মেরামতের চেয়ে কেনাকাটায় আগ্রহী রেল

রেলওয়েতে এক দিনের ব্যবধানে পৃথক দুইটি স্থানে দুই দুর্ঘটনার এখনও কোনো কারণ শনাক্ত করতে পারেনি রেলপথ অধিদপ্তর। সোমবার দুপুরে কুমিল্লার লাঙলকোটের হাসানপুর রেলস্টশনের কাছে চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পরে ৭ টি কোচ লাইনচ‚্যত হয়। এই ঘটনার একদিন পর সোমবার রাত ৯ টার ঢাকাগামী পঞ্চগড় এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশনের কাছে একটি কোচ লাইনচ‚্যত হয়। দুই ঘটনায় দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
একের পর এক ঘটে যাওয়া রেল দুর্ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির বৈঠকে কেন এই সকল দুর্ঘটনা ঘটছে তার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য পেতে ট্রেনে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন ও দুর্ঘটনার পূর্বে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন বন্ধের জন্য সেন্সর সিস্টেম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ. বি. এম ফজলে করিম চৌধুরী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম, শফিকুল ইসলাম শিমুল, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, মো. শফিকুর রহমান ও মোছা. নুরুন নাহার বেগম।
সারাদেশে রেলওয়ে উন্নয়নে একাধিক নতুন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সংস্কার হচ্ছে না পুরাতন রেল লাইন ও সেতু। সারাদেশের ৩৪শ’ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-জয়দেবপুর এবং যশোর-আব্দুলপুর রেললাইন ডাবল রেললাইন। বাকি রেললাইন সিঙ্গেল রেললাইন এবং বেশিরভাগই জরাজীর্ণ। তাই প্রতিনিয়ত লাইনচ্যুতিসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা ও লাইনচ্যুতির প্রায় ৬৩ শতাংশই হয় ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও দুর্বল সেতুর কারণে। গত ৫ বছরে দুই হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক যাত্রী ও পঙ্গু হয়েছেন ৫শ’ যাত্রী। এর মধ্যে গত ৪ মাসে সারাদেশে রেল দুর্ঘটনা ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ১৬০ টি। এসব ঘটনায় ১৮ জন যাত্রী নিহত হন। আহত হন ২শ জন যাত্রী। বেসরকারি গবেষকরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকায় এ সব দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
গণপরিবহণ বিশ্লেষক ও বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলে বর্তমানে একমুখী উন্নয়ন চলছে। নতুন নতুন লোকোমোটিভ, কোচ কেনা হচ্ছে। এসব কেনাকাটায় ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এতে যাত্রী সেবার মান বাড়ছে না। এই লোকোমোটিভ ও কোচ যখন দেশে আনা হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে যে এগুলো পরিচালনার জন্য মানসম্মত লাইন নেই। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ। এসব লাইন মেরামত না করেই কেনাকাটা করা হচ্ছে। এতে রেলের গতি বাড়ছে না। রেলের গতি কমছে। নতুন রেললাইনের পাশাপাশি পুরাতন রেললাইনগুলো মেরামত করতে হবে। মেরামতের পেছনে কম টাকা খরচ হয় বলে রেল সব সময় বাহির থেকে লোকোমোটিভ ও কোচ কেনায় আগ্রহী। আবার রেললাইন ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নামেমাত্র করা হচ্ছে। রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা কেনাকাটায় মন না দিয়ে বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ সংস্কার করাটাই হবে প্রথম কাজ।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। উন্নয়ন বাজেটেও অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর পরেও তেমন কোনো সুফল মিলছে না। একের পর এক স্টেশন বন্ধ, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জরাজীর্ণ রেল কারখানা, জনবল সংকট, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারা, টিকিট পেতে ভোগান্তি, টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্মসহ নানা অব্যবস্থাপনা লেগেই আছে।
সর্বশেষ সোমবার বিকালে কুমিল্লার হাসানপুর রেলস্টেশনের কাছে বিজয় এক্সপ্রেসের ৭ টি কোচ লাইনচ‚্যত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ৪ জন কিশোরকে গ্রেফতার করে। পুলিশ বলছে, ওই কিশোররা রেললাইনের ফিশপ্লটে খুলে ফেলায় বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার শিকার হয়।
এ ব্যাপারে রেলের পূর্বাঞ্চলের ডিআরএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি তদন্ত কমিটি তদন্ত করছে। এখনও সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। লাইনের কোনো ক্রুটি ছিল কি না এবং ট্রেনের যান্ত্রিক ক্রুটি ছিল কি না- বিষয়গুলো তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার টাঙ্গাইলের কাছে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশনের কাছে ঢাকাগামী পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের দুইটি কোচ লাইনচ‚্যত হয়। এ ব্যাপারে রেলের রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে। ওই ট্রেনের যান্ত্রিক ক্রুটি ছিল কি না- সে বিষয়টি তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে।
রেল মন্ত্রনালয়ের ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ি, সারাদেশে ৩১৫ টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এদের মধ্যে ১৪৩ টি ট্রেন বিগত ১৫ বছরে চালু করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মান করা হয়েছে। ১৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন মেরামত করা হয়েছে। ১৪৬ টি নতুন রেলস্টেশনের ভবন নির্মান করা হয়েছে। ২৭৩ টি স্টেশন ভবন পুনর্র্নিমাণ, ১০৩৭টি নতুন সেতু নির্মাণ, ৭৯৪টি রেলসেতু পুনর্র্নিমান, ১০৯টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ৬৫৮টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, ৫৩০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ, ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগন পুনর্বাসন ইত্যাদি।
রেলে বর্তমানে কোচ আছে ১ হাজার ৭৮৮, যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল শেষ। আর সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫, যার ৬০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। আর মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ২৪৭, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। রেলওয়েতে ৪৭ হাজার ৬শ জনবলের বিপরীতে মাত্র ২৪ হাজার জনবল রয়েছে।
বেসরকারি তথ্যমতে, বর্তমানে সারাদেশে ৩৪শ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন রয়েছে। এর মধ্যে মানসম্পন্ন রেললাইন মাত্র এক হাজার কিলোমিটার। সিগন্যালিং ত্রæটি, ঝুঁকিপূর্ণ রেল ক্রসিং, মেয়াদোত্তীর্ণ কোচ সংযোজন, জরাজীর্ণ রেললাইন, রেললাইন পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব ও জনবল অভাবের কারণে রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বিগত ১৫ বছরে রেল মন্ত্রনালয় ৬২ হাজার কোটি টাকায় বিদেশ থেকে লোকোমোটিভ, কোচ, মালবাহী ওয়াগন, লাগেজ ভ্যানসহ নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে। তবে পুরাতন রেললাইন মেরামত না করেই রেলের কেনাকাটা করা হয়েছে। জনবলের ব্যবস্থা না করেই পুরাতন রেললাইনে একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। নতুন রেললাইন নির্মাণ ও একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রকৌশলী দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, শুধু লাইন নয়, রেলওয়ে সেতুগুলোর অবস্থাও করুণ। মেয়াদোত্তীর্ণ অধিকাংশ সেতু জ্যাকেটিং সিস্টেমে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এসব সেতুর ওপর দিয়ে কোনো ট্রেনই নির্ধারিত গতি নিয়ে চলতে পারে না।
গণপরিবহণ বিশ্লেষক ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রেললাইন ও রেল সেতুগুলো জরাজীর্ণ এবং চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রেললাইন ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নামেমাত্র করা হয়। অথচ রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণে ব্যস্ত থাকেন। তাদের উচিত কেনাকাটা মন না দিয়ে বর্তমান রেলপথ সংস্কার করাটাই হবে প্রথম কাজ।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,100SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ সংবাদ