আবাসিক সমস্যা, সেশনজটের দুশ্চিন্তা, শিক্ষকদের অসহযোগিতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর গুলোতে অসদাচরণ, প্রশাসনের উদাসীনতা, জনবল শূন্য ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স সেল, ভাষাগত জটিলতাসহ প্রভৃতি কারণে ক্রমেই বিদেশী শিক্ষার্থীদের আস্থা হারাচ্ছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। ফলশ্রুতিতে পড়াশোনা শেষ না করেই এ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে অন্তত ২২ জন শিক্ষার্থী যার আনঅফিসিয়াল সংখ্যা আরও বেশি।
জানা যায়, অনেক দেশের তুলনায় আনুষঙ্গিক খরচের পরিমাণ কম ও বিভিন্ন সুনাম দেখে ইবিতে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি গাম্বিয়া, সোমালিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিদেশী শিক্ষার্থীরা আসতেন, ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তরে পড়াশোনা করতে। এরমধ্যে ভারত কিংবা নেপালের শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষা শিখতে পারলেও সোমালিয়া, গাম্বিয়া বা নাইজেরিয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য তা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। এছাড়া অধিকাংশ বিভাগের শিক্ষকরা বাংলায় পাঠদান করেন। বিদেশী শিক্ষার্থীদের বারবার অনুরোধের পরেও তারা ইংরেজিতে পাঠদান করেন না। পরবর্তীতে তাদের আলাদা ভাবে বুঝিয়েও দেননা। ফলশ্রুতিতে সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার একাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা সম্পন্ন না করেই ক্যাম্পাস ত্যাগ করে অন্যত্র পারি জমিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা যায়, ইবিতে বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে। সে বছর এম.ফিলে ২ জন, ¯œাতকোত্তরে ৪ জন এবং ¯œাতকে ১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এর মধ্যে শুধু ৩ জন শিক্ষার্থী তাদের ¯œাতকোত্তর শেষ করেন। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ¯œাতকোত্তরে ১৯ জন এবং ¯œাতকে ৩ জন ভর্তি হলেও ¯œাতকোত্তর ১৫ জন আর ¯œাতক শেষ করে ১ জন। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সর্বপ্রথম পি.এইচ.ডি শিক্ষার্থীসহ ভর্তি হয় ১৭ জন, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ১৪ জন, করোনা পরবর্তী সময়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তিতে ধস নামে। সেবছর ¯œাতকে মাত্র ১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও সেশন জটিলতায় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে কোনো বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ই›িজনিয়ারিং বিভাগের নেপালী শিক্ষার্থী সাজিদ রাইন বলেন, এখানে ভর্তির চার বছর অতিক্রম করলেও বর্তমানে তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে পড়ছেন। সেশনজটের কারণে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কখন ¯œাতক শেষ করবেন।
একাধিক বিদেশী শিক্ষার্থী জানান, এক একটা সেমিস্টারের রেজাল্ট দিতে দুই মাস বা তারও অধিক সময়ক্ষেপণ করা হয়। ফলে তারা সেশনজটে ভোগেন। বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা শিক্ষক কর্মকর্তাদের থেকে তেমন সৌহার্দ্য পাননা। ছেলেদের আলাদা হল থাকলেও নারীদের জন্য তা নেই। ছাত্রী হলেও বরাদ্দ নেই আলাদা বিদেশী শিক্ষার্থীদের সিট। ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুযোগ পেলে এখান থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন অনেকেই। নিজনিজ কমিউনিটিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতেও অনুরোধ করছেন কেউ কেউ।
ফার্মেসি বিভাগের নেপালী শিক্ষার্থী ইরফান বলেন, আমাদের ওয়াইফাই নষ্ট, ডাটা কিনে পরিবারে যোগাযোগ করতে হয়, বিভিন্ন সময় অনলাইন ক্লাস করতে হয়। পানির ফিল্টার দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে থাকে। বারবার অভিযোগ করে কোনো সমাধান পাইনা। পরিবার অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমাদের এখানে পড়তে পাঠিয়েছেন। তবে আমাদের কাছে এই পরিবেশ দুঃস্বপ্নের মতো। আমাদেরও যদি এখন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয় তাহলে এর থেকে দুঃখজনক হয়তো কিছু হবেনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু হেনা মোস্তফা জামাল বলেন, সেলের পরিচালক থাকলেও নেই নির্দিষ্ট দপ্তর। ছেলেদের জন্য হলের ব্যবস্থা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা হলের ব্যবস্থা নাই। শিক্ষকরা ইংরেজিতে পাঠদান করাতে চাননা। আমাদের সেলে কোনো স্টাফ নেই। সেখানে একটি ছেলে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতো তারও বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের ৮০% পর্যন্ত স্কলারশিপ দেয় সেখানে আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো উল্টো তাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। এতএত সমস্যার মধ্যে কি এই স্টুডেন্টরা এখানে ভর্তিতে অন্যদেরকে সুপারিশ করবে?
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, আমি মনে করি স্কলারশিপ না পাওয়া একটা বড় কারণ। অন্য দেশে পার্টটাইম কাজের সুযোগ আছে যা এ দেশে নেই। ভাষাগত একটা সমস্যা আছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা যদি তাদের প্রতি আলাদা নজর দেয় তবে এ সমস্যা থাকতোনা। যেসব বিভাগে জট আছে বিদেশীদের কথা চিন্তা করে হলেও বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, সকল কিছু ভিসির একার পক্ষে করা সম্ভব হয়না। যে এটার দায়িত্বে আছেন তাকে সব কাজ সামলে এ দিকটাও দেখতে হবে।