রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের সূত্রপাত ইলেকট্রিক কেটলি থেকে। ভবনটির নিচ তলার ‘চুমুক’ নামের চায়ের দোকানের চা তৈরির জন্য ব্যবহৃত ইলেকট্রিক কেটলি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। এরপর পুরা ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আগুনের তাপে এলপিজি (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) সিলিন্ডারের গ্যাসে আগুন ধরে যায়। এতে আগুনের লেলিহান শিখা বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের মধ্যে দুজন পুলিশের রিমান্ডে এমন তথ্য জানিয়েছেন। ওই ভবনের নিচতলায় ‘চা চুমুক’ দোকানের মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান রিমন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব কথা জানিয়েছেন।
অপরদিকে, চা চুমুক দোকানের ওই দুই ব্যক্তির তথ্যের সত্যতাও পেয়েছে বিস্ফোরক অধিদপ্তর। সংস্থাটির একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ইলেকট্রিক কেটলি বিস্ফোরণের নমুনা পেয়েছে। এ থেকে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নয়; ইলেকট্রিক কেটলি বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন জানান, তাদের পরিদর্শক দল কোন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আলামত দেখতে পায়নি। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে সিলিন্ডারের ধ্বংসাবশেষ থাকত, চতুর্দিক বিস্ফোরিত সিলিন্ডার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। অন্য রকম একটা পরিবেশ থাকত। কিন্তু এরকম কোন কিছুই পাওয়া যায়নি। এমনও নয় যে, আগুন লাগার পর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এখানে কোন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনাই ঘটেনি। তবে আমরা ইলেকট্রিক কেটলির ধ্বংসাবশেষ পেয়েছি, পোড়া তারও পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় যেহেতু মামলা হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত চলমান। তারা ঘটনাটি উদঘাটন করবে।
তিনি বলেন, এমন আগুনের ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে থাকে। ফায়ার সার্ভিস কিংবা পুলিশ যদি মনে করে তখন আদালতের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত আলামত বিস্ফোরক অধিদপ্তরে পাঠালে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন আলামত পরীক্ষার জন্য তাদের বলা হয়নি। কিন্তু আগুনে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটায় এবং সেখানে কোন বিস্ফোরক দ্রব্য ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখতে তারা ঘটনাস্থলটি পরিদর্শন করেছেন। তাদের টিম সেখানে কোন বিস্ফোরক দ্রব্যেরও উপস্থিতি পাননি।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুজন পুলিশকে জানিয়েছে, ইলেকট্রিক কেটলিটিতে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। তখন তারা দ্রæত আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তবে কিছুতেই আগুন নিভছিল না। এক পর্যায়ে কেটলির আশপাশে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্রে আগুন ধরে যায় এবং পুরো দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ওই ভবন থেকে পুলিশ ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে অক্ষত ১১টি গ্যাস সিলিন্ডার সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৬টি ছোট এবং ৫টি বড় গ্যাস সিলিন্ডার। সেগুলো রমনা থানায় রাখা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনছার মিলটন বলেন, উদ্ধারকৃত আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়া চলছে। মোট কথা তদন্তের স্বার্থে যা যা করা দরকার, সবই করা হচ্ছে। যাদের অবহেলায় ঘটনাটি ঘটেছে, তাদের যাতে শাস্তি নিশ্চিত হয়, সেভাবেই মামলার তদন্ত চলছে।
ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইসাব) এর পক্ষ থেকেও ঘটনার পরপর ভবনটি পরিদর্শন করা হয়। এ ব্যাপারে ইসাব এর সাধারণ সম্পাদক জাকির উদ্দিন আহমেদ বলেন, তারাও পরিদর্শনে কোন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আলামত পাননি। তবে গ্যাস সিলিন্ডার ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে ছিল। সেগুলো অক্ষত অবস্থায়। তারা নিন্ম মানের একটি ফায়ার এক্সটিংগুইসার বিস্ফোরণ অবস্থায় পেয়েছেন এবং সুয়ারেজ লাইন বিস্ফোরণ অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন।
এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে। তবে তদন্তে এখন পর্যন্ত কি পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলছেন, তদন্ত শেষ হলে এ বিষয়ে মন্তব্য করা হবে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোন আলামত পাওয়া গেছে কিনা, সেটিও বলতে নারাজ তারা।
এদিকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রিন কোজি কটেজে এখনো পুলিশ মোতায়েন অবস্থায় রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে বেইলি রোডের ভবনটিতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। ভবনটির সামনে ফিতা দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ। কোন সংস্থা কিংবা সংশ্লিষ্টরা ছাড়া অন্য কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের কয়েক ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় এখনো ৬ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বেশ কয়েকজন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন।