প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপচয় বন্ধ করতে আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে সরকারিভাবে বড় ধরনের কোনও ইফতার পার্টি উদযাপন না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। বেসরকারিভাবেও এই ধরনের আয়োজনকে নিরুৎসাহিত করে তিনি বলেন, কারো যদি এ ধরনের অনুষ্ঠান করার ইচ্ছা থাকে তাহলে যেন সেই অর্থে খাদ্য কিনে গরীব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এর মূল বার্তা হচ্ছে অপচয় যেন না করি। লোক দেখানো কার্যক্রমে যেন নিজেদের নিবেদিত না করি। খাদ্য ও অর্থের অপচয় হলে ধর্মীয় দিক থেকে কোনও যৌক্তিকতা থাকে না।
গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠক শেষে বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রেস ব্রিফিং করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে যে নির্দেশনা এসেছে যে, রমজান মাসে সরকারিভাবে কোন বড় ইফতার পার্টি নামে কোনো কিছু উদযাপন করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ইফতার পার্টি করারই বা কারণ কী, বলতে পারেন? এটা কি কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান? সাংবাদিকরা জানান, আগে ইফতার পার্টি হয়েছে, অনেকে ধর্মীয়ভাবেও এটি করেন। তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটি কখনই ধর্মীয় ইস্যু নয়। আপনাদের বুঝতে হবে আমরা যেন অপচায় না করি। আমরা যেন লোক দেখানো কার্যক্রমে নিজেদের নিয়োজিত না করি। তার বদলে ওই টাকাটা যদি আপনি কারো কল্যাণে ব্যবহার করতে চান; গরীব মানুষ যাদের টার্গেট করলেন, তাদেরকে আপনি বিলিয়ে দিতে পারেন। আমি-আপনি বসে খেলাম, ওখানে অনেক খাদ্যের অপচয় হলো, অর্থের অপচয় হলো। এটার তো ধর্মীয় দিক থেকেও যুক্তি থাকতে পারে না।’ প্রতিবছর রোজায় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বিভিন্ন পেশাজীবী, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ইফতার করেন। প্রধানমন্ত্রী এবার ইফতারের আয়োজন করবেন কিনা এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটা তো আমি বলতে পারব না।’
অন্য বছরের মতো এবারও রমজান মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিসের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘হিজরি ১৪৪৫ (২০২৪ খ্রিস্টাব্দ) সালের পবিত্র রমজান মাসে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য অফিস সময়স‚চি নির্ধারণ’ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, রমজানে দুপুর সোয়া ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত জোহরের নামাজের বিরতি থাকবে। সাপ্তাহিক ছুটি যথারীতি শুক্র ও শনিবার। ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ডাক, রেলওয়ে, হাসপাতাল ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা এবং অন্য জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এ সময়স‚চির আওতার বাইরে থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী জনস্বার্থ বিবেচনা করে সময়স‚চি নির্ধারণ ও অনুসরণ করবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট ও এর আওতাধীন সব কোর্টের সময়স‚চি সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১২ বা ১৩ মার্চ থেকে মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস রমজান শুরু।
অফশোর ব্যাংকিং আইন অনুমোদন: মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘অফশোর ব্যাংকিং আইন, ২০২৪’র খসড়ার নীতিগত ও চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এই আইনের মাধ্যমে অনিবাসী বক্তি বা বাইরের কোন প্রতিষ্ঠান, যারা এখানে ইনভেস্ট করবে, তারা অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। অফশোর বাংকিং করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। তবে যারা আগেই লাইসেন্স পেয়েছে, তাদের নিতে হবে না। তিনি বলেন, মার্কিন ডলার, ইউরো, পাউন্ড, জাপানী ইয়েন ও চায়নিজ ইয়ান মুদ্রায় ব্যাংকিং কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে। এই আইনের আওতায় অফশোর বাংকিং করার জন্য তফশিলি ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো লাইসেন্স গ্রহণ করবে। এরপর অনিবাসী বাংলাদেশে বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত গ্রহণ করতে পারবে, ঋণ দিতে পারবে। ওই আমানত স্বাভাবিক ব্যাংকি পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবেন। বিদেশে যে বাংলাদেশী আছেন, তার পক্ষে তার কোনো আত্মীয় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন, সহায়তাকারী হিসেবে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন। অফশোর ব্যাংকিয়ের ক্ষেত্রে কোন ঋণ সীমা বেধে দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে মো. মাহবুব হোসেন বলেন, যে কোন পরিমান ঋণ নিতে পারবে। সমসাময়িক আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে, অফশোর ব্যাকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে এটি বাংলাদেশে প্রথম ইপিজেডে শুরু হয়, সেখানে কিন্তু কারেন্ট অ্যাকাউন্টের মতো কোন ইন্টারেস্ট দেওয়া হয় না। এখন অফশোর বাংকিংয়ে ইন্টারেস্ট দেওয়া হবে। ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে পারলে, ব্যাংকের নরমাল ব্যবসার প্রয়োজনে সে যখন বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তার তুলনায় ব্যয় কম হবে। মাহবুব হোসেন বলেন, বহু দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ও আর্থিক কাঠামো সমৃদ্ধ করেছে। তারা শত শত বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট পেয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশীরা বালাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাকিং ব্যবস্থায় যখন টাকা জমা রাখে, তখন কিন্তু টাকা নিয়ে যেতে পারমিশন নিতে হয়। অফশোর হলে স্বাধীনভাবে এটা অপারেট করা যাবে। এখানে ব্যবসা করে যারা লাভবান হবে, তারা এখানে টাকা রাখতে আগ্রহী হবে বলে আমরা আশা করছি। মাহবুব হোসেন বলেন, শুধু রিজার্ভ বাড়াতেই এটি করা হচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবে আমরা লাভবান হবো, সেজন্য আমরা এটি করছি। আইন অনুযায়ী ওই অ্যাকাউন্টে যে লেনদেন হবে, সেই সুদের ওপর কোন শুল্ক আরোপ করা হবে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ইকোনমির দিকে তাকিয়ে এটি চালু করা হচ্ছে। সরকার মনে করছে, এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক দেশ সুফল পেয়েছে। তিনি বলেন, সেভিংস আকাউন্ট যেভাবে পরিচালনা করা হয়, সেভাবেই এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা যাবে। ওই অ্যাকাউন্টে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা জমা দেওয়া যাবে।
মন্ত্রিসভার আকার বাড়ানো নিয়ে যা বললেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব: আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার আকার বাড়তে পারে- এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, আমার কাছে এখন পর্যন্ত এরকম কোনো সংবাদ নেই। সেরকম কিছু হলে অবশ্যই আপনারা জানবেন। নির্ধারিত সময়েই জানবেন। গত সাত জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। এর পর থেকেই আলোচনা রয়েছে যে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমান মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী বাদে প‚র্ণমন্ত্রী রয়েছেন ২৫ জন এবং প্রতিমন্ত্রী ১১ জন। মোট ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায় কোনো উপমন্ত্রী নেই। উল্লেখ্য, একাদশের মন্ত্রিসভায় মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৯ জন।
প্রধানমন্ত্রী নিজের রচিত দু’টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতিসংঘ ও জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের ওপর তাঁর রচিত দু’টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন। শেখ হাসিনার রচিত বই ‘সকলের তরে সকলে আমরা’-তে তাঁর জাতিসংঘে দেওয়া ১৯টি ভাষণ এবং সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ স্থান পেয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর রচিত অপর গ্রন্থ ‘আবাহন’ এ ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তাঁর গুরুত্বপ‚র্ণ ভাষণগুলো স্থান পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর স্পীচ রাইটার এম. নজরুল ইসলাম বই দু’টির গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেন।