দেশের ব্যবসায়ীরা সম্পদশালী হওয়ার জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তার মতে বর্তমানে দেশে ঋণ খেলাপি হওয়া একটি ‘বিজনেস মডেলে’ পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সম্পদশালী হওয়ার এই কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন একশ্রেণির পুঁজিপতিরা। ফলে যারা ঋণ নিয়ে প্রকৃত ব্যবসা করতে চায় তারা সমস্যায় পড়ছে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের লেভেল প্লেয়িং ফিন্ড নস্ট হচ্ছে। স্বজন-তোষণের রাজনীতির বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল শনিবার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে একটি অধিবেশনে এ মন্তব্য করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। অধিবেশনের মূল বিষয়বস্তু ছিলো দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো। এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, এই ভ‚খন্ডে স্বাধীনতার আগে থেকেই এক দলের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক অবস্থানের অস্তিত্ব ছিলো। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ সময় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে মূলত এক দল আওয়ামীলীগের আধিপত্য ছিল। পরবর্তীতে মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করলেও সেটি রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এমনকি স্বাধীনতার পরও আওয়ামী লীগের সেই শক্তিশালী অবস্থান বজায় ছিলো। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলেও একক দলের আধিপত্য বিরাজমান ছিলো। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়েও সেটি ছিলো। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন হওয়ার পর থেকে। সেসময় খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমনের পর রাজনীতিতে এক দলের পরিবর্তে দুই দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যা এখনো বলবৎ আছে। তিনি বলেন, ‘ডমিনেন্ট পলিটিক্যাল সিস্টিম’ বলতে যা বোঝায়, সেটি বাংলাদেশে হয়নি। এমন উদাহরণ পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরে। দেশটিতে একক দলের আধিপত্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে প্রতিষ্ঠান অনেক শক্তিশালী এবং সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। কিন্তু বাংলােেশ উল্টো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এদেশে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে উল্টো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দুর্বল করে তোলা হচ্ছে। এসময় তিনি নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদাহরণ দেন। উন্নত দেশের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিত ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। দেশের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কেন্দ্রীক হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর শাসনআমলে এককেন্দ্রীকতা ছিল কিন্তু মন্ত্রী পরিষদের কাজ করার স্বধীনতা ছিল, পরিকল্পনা কমিশন কার্যকর ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জিয়ার আমলে ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কেন্দ্রীক হয়ে পরে। জিয়ারউর রহমানের সময় রাজনীতির সঙ্গে পুঁজিপতিদের সংযোগ ঘটে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই সময় অনেক ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় আনুক‚ল্যে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিশেষ করে অনেক তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী রাষ্ট্রীয় আনক‚ল্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন এবং ওইসব পুঁজিপতিদের রাজনীতির সঙ্গে একটি সংযোগ গড়ে ওঠে। সেই ব্যবস্থা এখনো চলমান রয়েছে। এখনও ব্যবসায়ীরা সম্পদশালী হওয়ার জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভনেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র গবেষণা ফেলো ড. মির্জা এম হাসান। তিনি বলেন, দেশে একটি ডমিনেন্ট পলিটিক্যাল সিস্টেম (ডিপিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে অন্যদলগুলো রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চায় জোরালো ভ‚মিকা রাখতে পারছে না। তিনি উল্লেখ করেন, আগামী পাঁচ বছর সরকারি দল নানাভাবে বিএনপির পেছনে লেগে থাকবে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য। এ কাজে যদি তারা সফল হয়, তাহলে দেশে কার্যকরভাবে একদলের আধিপত্যবাদী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দল ক্ষমায় বসেছে তারা কি রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসছে নাকি রাষ্ট্র কাঠামোকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসছে, সে আলোচনা তোলার সময় এসেছে। দেশে রাজনৈতিক দলীয় সিস্টেম ভঙ্গুর হয়ে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সামরিক শাসকরাও রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সবাই ক্ষমতায় থেকেছে রাষ্ট্র কাঠামোকে ব্যবহার করে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বাংলাদেশে একদলীয় আধিপত্যবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ একদলের শাসন ব্যবস্থা ব্যক্তিকেন্দ্রীক হয়ে থাকে। ফলে দলীয় উত্তরাধিকার না থাকলে একদলীয় আধিপত্য আর টিকবে না। আলোচনায় অংশ নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হয়েছে বলা যায়। তবে দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়নি। কারন যারা ক্ষমতায় গিয়েছেন তারাই ক্ষমতা ধরে রাখার চেস্টা করেছেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সুষ্টু নির্বাচন হলেই সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। যারা জয়ী হয়েছেন তারাই ক্ষমতা স্থায়ী করতে চেয়েছেন।