দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে ৪৮ জন প্রার্থী চ‚ড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। প্রার্থী মনোনয়নে নতুনে আস্থা রেখেছে দলটি। ৩৪ জনই প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে ৪৩ জনকে মনোনিত করেছিলো আওয়ামী লীগ। সেই ৪৩ জনের মধ্যে ৩৬ জনই এবার বাদ পড়েছেন। গতবার সংরক্ষিত আসনে এমপি ছিলেন এমন সাত জন আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল থেকে পেয়েছেন একজন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৮ জন চ‚ড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন। এদের মধ্যে চার জন প্রথমবার মনোনীত হলেন। এছাড়া টানা চার বার সংসদে দলীয় মনোনয়ন পেলেন ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরা। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে হেরে গেছেন এবং মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে-এরকম তিনজন এবার সংরক্ষিত আসনে এমপি হওয়ার টিকেট পেয়েছেন।
গতকাল বুধবার গণভবনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মতবিনিময় করেন। পরে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তার সভাপতিত্বে গণভবনে দলটির সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ১৫৫৩টি আবেদনপত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সর্বসম্মতিক্রমে ৪৮ প্রার্থী চ‚ড়ান্ত করা হয়। সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রেস ব্রিফিংয়ে দল মনোনিত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। আগামী রবিবার চ‚ড়ান্ত প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেবে আওয়ামী লীগ।
এবার প্রতি আসনে গড়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন ৩২ জনের বেশি। নতুনদের সুযোগ করে দেওয়ার নীতিতে একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের পাওয়া ‘সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলোতে’ বেশিরভাগই নতুন মুখ দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। নবম, দশম ও একাদশের ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও সরকার দলের পাওয়া সংরক্ষিত আসনে বেশিরভাগ নতুন মুখ।
ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান। তিনি টানা তিন বার সংসদ সদস্য হচ্ছেন। কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ল²ীপুর-৪ আসনের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাসদকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ার কারণে তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়। তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক শামসুন নাহার চাঁপা প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন। দলের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা এবার প্রথম মনোনয়ন পেলেন। দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। সংরক্ষিত আসনে তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। দলটির কার্যনির্বাহী সদস্য তারানা হালিম আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি এর আগে নবম ও দশম জাতীয় সংসদের এমপি ছিলেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসনে প্রতিদ্বনি›দ্বতা করে পরাজিত হয়েছিলেন দলটির কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানম। তিনি নবম সংসদে এ আসনের এমপি ছিলেন। এরপর দশম সংসদে সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। আবারও সংরক্ষিত আসনের মনোনয়ন পেলেন। প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির আরেক কার্যনির্বাহী সদস্য পারভীন জামান কল্পনা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আট জন সদস্য এমপি পদে মনোনয়ন পেয়েছেন। তাদের মধ্যে চার জনই প্রথম মনোনয়ন পেলেন।
টানা চতুর্থ বারের মতো সংরক্ষিত আসনের এমপি পদে মনোনয়ন পেয়েছেন মন্ত্রিসভার সদ্য সাবেক সদস্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরা। গত তিন সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৩ আসনে এমপি ছিলেন মুন্নুজান সুফিয়ান। গত মন্ত্রিসভার শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। দ্বাদশ নির্বাচনে ওই আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় এবার সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। টানা দ্বিতীয়বারের মতো দলের মনোনয়ন পেয়েছেন মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শবনম জাহান, নাহিদ ইজাহার খান, ওয়াশিকা আয়শা খানম, আরমা দত্ত, অপরাজিতা হক, ফজিলাতুন নেসা ও ফরিদা খানম। মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি গত তিন সংসদে গাজীপুর-৫ আসনের এমপি ছিলেন। দ্বাদশেও মনোনয়ন পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এবার তিনি সংরক্ষিত আসনের এমপি হচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী ছাড়া বাকি ৩০ জন নতুন মুখ হলেন রেজিয়া ইসলাম (পঞ্চগড়), দ্রৌপদী দেবী আগরওয়ালা (ঠাকুরগাঁও), আশিকা সুলতানা (নীলফামারী), যুব মহিলা লীগের সাবেক সহভাপতি কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি (নাটোর), জারা জাবিন মাহবুব (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), রুনু রেজা (খুলনা), ফরিদা আক্তার বানু (বাগেরহাট), ফরজানা সুমি (বরগুনা), খালেদা বাহার বিউটি (ভোলা), নাজনীন নাহার রশিদ (পটুয়াখালী), জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন (নরসিংদী), উম্মি ফরজানা সাত্তার (ময়মনসিংহ), নাদিয়া বিনতে আমিন (নেত্রকোনা), মাহফুজা সুলতানা মলি (জয়পুরহাট), লায়লা পারভীন (সাতক্ষীরা), বেদৌরা আহমেদ সালাম (গোপালগঞ্জ), পারুল আক্তার (ঢাকা), সাবেরা বেগম (ঢাকা), ঝর্ণা হাসান (ফরিদপুর), অনিমা মুক্তি গোমেজ (ঢাকা), শেখ আনার কলি পুতুল (ঢাকা), মাসুদা সিদ্দীক রোজি (নরসিংদী), হাছিনা বারী চৌধুরী (ঢাকা), রুমা চক্রবর্তী (সিলেট), আশ্রাফুন নেছা (ল²ীপুর), কানন আরা বেগম (নোয়াখালী), শামীমা হারুন লুবনা (চট্টগ্রাম), দিলোয়ারা ইউসুফ (চট্টগ্রাম), জ্বরথি তঞ্চঙ্গ্যাঁ (রাঙামাটি), নাছিমা জামান ববি (রংপুর)।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রুনু রেজা বিথার। তিনি যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কেসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শহীদ ইকবাল বিথারের স্ত্রী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের ছোট বোন। রুনু রেজা বিথার ২০১০ সালে তার স্বামী শহীদ ইকবাল বিথার সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হলে উপ-নির্বাচনে কেসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তিনি খুলনা সিটি গার্লস কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এছাড়া খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) সদস্যসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এদিকে কানন আরা বেগম ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল গণতন্ত্রী পার্টির রাজনীতি করেন। জোটের বিবেচনায় স্বতন্ত্র হিসেবে তাকে মনোনীত করেছে আওয়ামী লীগ।
দ্বাদশ সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনে আগামী ১৪ মার্চ ভোটের দিন রেখে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ১৮ ফেব্রæয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। সংসদে নৌকা প্রতীকে জয় পাওয়া ২২৫ এমপির হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আনুপাতিক হারে পচ্ছে ৩৮টি সংরক্ষিত আসন। ৬২ স্বতন্ত্র এমপির সঙ্গে মতৈক্য হওয়ায় তাদের ভাগের ১০ আসনেও আওয়ামী লীগই প্রার্থী দিল। সে হিসাবে আওয়ামী লীগ এবার পাচ্ছে ৪৮টি সংরক্ষিত আসন। বাকি দুটি সংরক্ষিত আসন পাচ্ছে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। ১৪ মার্চ ভোটের দিন রাখা হলেও মনোনয়নের বাইরে কারো প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না থাকায় ভোটের আর প্রয়োজন পড়ে না। ৫০ আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (জাপা) যাদের মনোনয়ন দেবে, ২৫ ফেব্রæয়ারি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হওয়ার দিনই তাদের বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।
কোন জেলা থেকে কত জনকে মনোনয়ন: এবার সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র বিক্রি করে আওয়ামী লীগের আয় হয়েছে ৭ কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবার সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ঢাকা জেলা থেকে। এই জেলার ৯ জন দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মনোনয়ন দেয়া হয়েছে টাঙ্গাইল এবং চট্টগ্রাম জেলা থেকে। এই দুই জেলার ৩ জন করে সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। ২ জন করে মনোনয়ন পেয়েছেন নোয়াখালী, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী এবং গোপালগঞ্জ থেকে। আর একজন করে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে- বরিশাল, মুন্সীগঞ্জ, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নাটোর ,পঞ্চগড়, নীলফামারী, নেত্রকোনা, গাজীপুর, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, রংপুর, সাতক্ষীরা, রাঙ্গামাটি এবং ফরিদপুর জেলা থেকে।