সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের এক যুগেও রহস্যের জট খোলেনি। এখনো আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের পর্যায়েই আটকে আছে তদন্ত। যদিও র্যাবের পক্ষ থেকে বরাবরের মতো দাবি করা হচ্ছে, মামলার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু অতীতের মতো এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। উল্টো ১০৫ বার পেছানো হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে আগামী ২৭ ফেব্রæয়ারি নির্ধারণ করেছেন আদালত। ফলে নিহতদের স্বজনদের প্রশ্ন, হত্যাকারী গ্রেফতারের আল্টিমেটাম ৪৮ ঘন্টা ১২ বছরেও শেষ হলো না। আর কবে খুনিরা ধরা পরবে। কবে রহস্যের জট খুলবে।
এক যুগ আগে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ বাড়ির ৫ তলার এ-৪ ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। খুনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরের দিন রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার একজন কর্মকর্তা। ১৬ ফেব্রæয়ারি মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর। তবে এর দুই মাস পর হাইকোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র্যাবকে। সেই থেকে এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, এক যুগে কোনো অগ্রগতি নেই, আর কবে হবে। কোনো অগ্রগতি হবে না। আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। শুধু এতটুকু বলতে পারি, তদন্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে কাজ করছেন না। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ প্রতিবছর তারা নিয়ম মাফিকভাবে বলে আসছেন, দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই নয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালতও যেখানে বার বার সময় দিচ্ছেন, সেখানে আমাদের আর কি বলার আছে! তবে, জট খোলার চেষ্টা না করলে জট খুলবেনা, এটাই স্বাভাবিক।
এ ব্যাপারে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকর আলী শুভ বলেন, আমরা আজো সাগর-রুনি হত্যার বিচার পাইনি। এই হত্যার বিচার করতে হবে। যত দ্রæত সম্ভব এই মামলার চার্জশিট দিতে হবে। চার্জশিট অনুযায়ি আসামীদের গ্রেফতার করতে হবে। মামলার চার্জশিট প্রদান ও আসামীদের গ্রেফতারের দাবিতে রবিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ সমাবেশ করবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত কোনো হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে হত্যাকান্ডের পেছনের কারণ খোঁজেন। এরপর আসামি শনাক্তকরণের চেষ্টা করেন, কোনো ধরনের ক্লু পেতে জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তির খোয়া যাওয়া মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এসব একটি মামলা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম, এক যুগ ধরে তদন্তের পরও সাগর-রুনি হত্যা মামলা ঠিক এরুপ প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। এখনো আসামি শনাক্তকরণ, জব্দকৃত আলামত পরীক্ষা ও নিহতদের খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টায় রয়েছে তদন্ত সংস্থা।
র্যাব মামলার তদন্তে নেমে গ্রেফতারকৃত ৮ আসামি, নিহত দুইজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে পেয়েছে র্যাব। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুইজনের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল পাওয়া গেছে। তবে এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেফতারকৃত ৮জনের মধ্যে পাঁচজন- রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীর। এদের মধ্যে সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
হত্যা মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এই মামলাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল মামলা। এই মামলা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তদন্ত করছি। এর জন্য বিদেশে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়েছি। বিদেশে ডিএনএ টেস্টের সহযোগিতা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করছি। তদন্তে একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি যেন দোষী না হয়। প্রকৃত দোষীরা শনাক্ত করার জন্য একটু সময় লাগছে। আমাদের যিনি তদন্ত কর্মকর্তা তিনি অত্যন্ত সুষ্ঠভাবে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।