বিনোদন জগতের তারকাদের মধ্যে ফরম ক্রয় করেন অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, শাহনর, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী
কর, সোহানা সাবা, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়‚ন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ অনেকে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে নতুন মুখদের মনোনয়ন দিতে চায় আওয়ামী লীগ। এক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেত্রীদের পাশাপাশি জায়গা পাবেন পেশাজীবীরা। এর মধ্যে আছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের তারকারাও। সংরক্ষিত মহিলা আসনে দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র বিক্রি ও জমাদান কার্যক্রম গতকাল বুধবার থেকে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।
সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম দিনেই ৮১০টি ফরম বিক্রি হয়েছে। প্রতিটি ফরমের ম‚ল্য ৫০ হাজার টাকা হওয়ায় আয় হয়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়া যাবে। গতকাল দিনভর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও এর আশাপাশ এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে। নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে ¯েøাগানমুখর ছিলেন নেতাকর্মীরা। বিনোদন জগতের তারকাদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
প্রথম দিনই ফরম ক্রয় করেন অনেক নায়িকা-অভিনেত্রী। এরমধ্যে রয়েছেন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, শাহনূর, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, অভিনেত্রী সোহানা সাবা, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়‚ন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ অনেকে। আগামী ১৪ মার্চ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে সংরক্ষিত আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে সরকার গঠনের পর থেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নারী নেত্রীরা। তাদের মধ্যে আছেন মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগসহ আন্দোলন-সংগ্রামে দলের জন্য নিবেদিত সাবেক ছাত্রনেত্রী। এছঅড়া আছেন বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সংস্কৃতি অঙ্গনের তারকাও। তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ধরনা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের কাছেও। জানাচ্ছেন আন্দোলন ও নির্বাচনে দলের পক্ষে ভ‚মিকার কথা। দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নানা ত্যাগ ও অর্জনের কথা তুলে ধরে বায়োডাটা জমা দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণে কেউ কেউ বায়োডাটা গণভবনেও জমা দিচ্ছেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েও আবেদন করেছেন। আওয়ামী লীগের পাঁচ জন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নতুনদের সুযোগ করে দেওয়ার নীতিতে গত জাতীয় সংসদের প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগের পাওয়া ‘সংরক্ষিত মহিলা আসনগুলোতে’ বেশিরভাগই নতুন মুখ দেখা গেছে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। নবম, দশম ও একাদশের ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও সরকার দলের পাওয়া সংরক্ষিত আসনে বেশিরভাগ নতুন মুখ আসছে। এক্ষেত্রে সংগঠনের ত্যাগী, বঞ্চিত, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রভাবশালী নারী নেত্রীদের প্রাধান্য দেওয়া হতে পারে।
সংবিধান অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক দলের ছয়জন নির্বাচিত সংসদ-সদস্য থাকলে ওই দল থেকে একজন প্রার্থী সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ-সদস্য হবেন। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের (একটি স্থগিত রয়েছে) মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয়লাভ করেছে। এছাড়া স্বতন্ত্ররা জয়ী হয়েছেন ৬২টি আসনে। আসনের সংখ্যানুপাতে এককভাবে আওয়ামী লীগের ৩৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসন পাওয়ার কথা। এছাড়া জাতীয় পার্টি (জাপা) দুটি ও স্বতন্ত্ররা ১০টি আসন এবং বাকি তিনটি দল একত্রে এলে একটি আসন পাওয়ার কথা। তবে ইতিমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের অংশের সংরক্ষিত আসনগুলো আওয়ামী লীগকে ছেড়ে দিয়েছে। ১৪ দলের শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এখন ৫০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ৪৮টি পাচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি প্রতিনিধি দল ৪৮টি আসন প্রাপ্তির বিষয়ে তাদের দল ও জোটগত তথ্য জমা দিয়েছে। বাকি দুটি আসন পাচ্ছে বিরোধী দল জাপা। গতকাল সকালে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, এস এম কামাল হোসেন, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ। পরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় সংরক্ষিত নারী আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দেবে আওয়ামী লীগ। আমাদের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের পর থেকেই পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে কাজ শুরু করে দেন। জেলা সফরে গিয়েও যোগ্য কাউকে দেখলে তার নাম লিখে রাখেন। সময়মতো সেটা কাজে লাগান। সংস্কৃতি অঙ্গনের কেউ কেউ মনোনয়ন পেতে পারেন বলে আভাস দেন ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্থাপিত প্রশাসনিক বিভাগ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট বুথ গিয়ে সংগ্রহ এবং জমা দেওয়া যাবে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং তৃতীয় তলায় রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের মনোনয়ন ফরম বিতরণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় সব বিভাগের মনোনয়ন ফরম জমা নেওয়া হচ্ছে। আবেদনপত্র সংগ্রহের সময় প্রার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সঙ্গে আনতে হবে এবং ফটোকপির ওপর মোবাইল নম্বর ও সাংগঠনিক পরিচয় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। গতকাল ফরম কেনার পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে চিত্রনায়িকা নিপুণ আক্তার বলেন, ‘প্রথমত দোয়া চাই সবার। প্রধানমন্ত্রী যদি যোগ্য মনে করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই বিবেচনা করবেন। ইতিপ‚র্বে দেশবাসীর কাছে যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, সেটাই চাই।’ বেলা ১১টার পর কার্যালয়ে এসে ফরম ক্রয় করেন চিত্রনায়িকা শাহন‚র (সৈয়দা কামরুন নাহার শাহন‚র)। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। বিরোধী দলের আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিলাম। আমি নিজেও সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনীত করলে আমি তার কথা অনুসারে কাজ করতে চাই। নারীদের জন্য কাজ করতে চাই।’ চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস আগে থেকেই বলে এসেছেন, তিনি সংরক্ষিত আসনে এমপি হতে চান। সেই লক্ষ্যে গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন তিনি। এছাড়া অভিনেত্রী তানভীন সুইটি, চিত্রনায়িকা জাকিয়া মুন প্রমুখ ফরম কিনেছেন বলে জানা গেছে। সকাল সোয়া ১০টার দিকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন অভিনেত্রী সোহানা সাবা। মনোনয়ন পেলে কীভাবে মানুষের সেবা করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নতুন জেনারেশন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই। আমরা যা দেখি দেশকে ও দেশের মানুষকে সেভাবে দেখতে চাই। সাধারণ মানুষের মতোই আমি হাঁটাচলা করি। পাঁচ টাকার জিনিস আমি ফুটপাত থেকে কিনি। সেই অভিজ্ঞতাও আমার আছে।
শৈশব থেকেই পোলিওর সঙ্গে লড়াই সালমা মাহবুবের। তবে সেই লড়াইয়ে হার মানতে হয় কয়েক দশক আগে। হয়ে যান পঙ্গু। এরপর থেকে চলাফেরা করেন হুইলচেয়ারে বসে। গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন ফরম নিতে সেই বাহনে চড়েই হাজির হন ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। ঢাকা বিভাগ থেকে সংগ্রহ করেন মনোনয়ন ফরম। সালমা মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, গত কয়েক দশক ধরেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কাজ করছি। জাতীয় সংসদে গিয়ে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে আরো বেশি কাজ করতে চাই।
আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী নারী নেত্রীদের ভিড় দেখা যায়। ২৬ জানুয়ারি শতাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী নারী নেত্রী কার্যালয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাদের সঙ্গে কথা বলেন। অনেকেই দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) জমা দেন। এ সময় দলের নারী নেত্রীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখানে কারও কিছু করার নেই। এর একদিন আগে ২৫ জানুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। সেখানে সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী নেত্রীদের অনেকেই ছিলেন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী নেত্রীদের উদ্দেশে বলেন, যারা বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন, সংরক্ষিত নারী আসনের আশায় তাদের আগেই পদত্যাগ করার দরকার নেই। দল মনোনয়ন দিলে তখন দেখা যাবে। তার আগে এক পদের আশায় আরেকটা পদ ছাড়া যাবে না।
গতকাল প্রথম দিনের ফরম বিক্রি শেষে আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান বলেন, প্রথম দিনে মোট ৮১০টি ফরম বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগ থেকে ২৭৫টি, ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে ৬২টি, চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৪৯টি, সিলেট বিভাগ থেকে ২৬টি, বরিশাল বিভাগ থেকে ৫৬টি, খুলনা বিভাগ থেকে ৭৭টি, রংপুর বিভাগ থেকে ৭৫টি এবং রাজশাহী বিভাগ থেকে ৯০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে।