নিহতদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী নারী, অপরজন রোহিঙ্গা
সীমান্তের ওপারে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায়
তমব্রæ সীমান্তের ওপারে রাত-দিন ভারি গোলা বর্ষণ
বিজিবি হেফাজতে ১০৬ বিজিপি সদস্য
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হয়েছেন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। সোমবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মর্টার শেলটি এসে পড়লে তারা নিহত হন। নিহত নারী জলপাইতলী গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৫৫)। নিহত রোহিঙ্গা নাগরিকের নাম নবী হোসেন (৬৫)। তিনি বালুখালী আশ্রয়শিবিরের ৮-ই বøকের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি হোসেনে আরার বাড়িতে ধানখেতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা পৌনে তিনটার দিকে রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে দুপুরের খাবার দেওয়ার জন্য রান্নাঘরে যান হোসনে আরা। তখন মর্টার শেলটি এসে রান্নাঘরের ওপর পড়ে প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থলেই ওই দুই জন নিহত হন। এসময় হুবায়েব(২) নামে এক শিশু আহত হয়।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ এই দুজনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বেলা পৌনে তিনটার দিকে রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে দুপুরের খাবার দেওয়ার জন্য রান্নাঘরে যান হোসনে আরা। তখন মর্টার শেলটি এসে রান্নাঘরের ওপর পড়ে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি আবদুল মান্নান বলেন, দুপক্ষের গোলাগুলির সময় মর্টার শেল এসে বিস্ফোরিত হয়েছে। তখন ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হয়েছেন।
এর আগে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রæপ আরাকান আর্মিদের সঙ্গে মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও মিয়ানমার সীমান্ত বাহিনী বিজিপির প্রচন্ড গোলাগুলির মুখে টিকে থাকতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০৬জন মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এর সদস্য। তাদের মধ্যে আহত ৯ জনকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপারে বসবাস করা মিয়ানমারের চাকমা জনগোষ্ঠ এবং রোহিঙ্গা নাগরিকরা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় জড়ো হচ্ছে বলে তমব্রæ সীমান্তের ওপার থেকে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারে তমব্রæ লেফট, তমব্রæ রাইট ও ঢেকুবুনিয়া ক্যাম্প থেকে উখিয়া ও টেকনাফের বিপরীতে মিয়ানমারের সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয়েছে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সীমান্তে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা।
তমব্রæ সীমান্তে থমথমে পরিস্থিতি ঃ
তমব্রæ সীমান্তের জলপাইতলী গ্রামে এক ধরনের থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। দুপুরে মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুই জন নিহত হওয়ার পর প্রায় সবাই ওই গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে থাকেন। তমব্রæর পশ্চিম কুল এলাকায় বসতবাড়ি ও ঘোনার পাড়ায় ২টি মর্টার শেল দুইটি বাড়িতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। তবে ওই দুই বাড়িতে কেউ ছিলেন না বলে, হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শী সাইফুল ইসলাম জানান। সীমান্তের কোনার পাড়া, মাঝের পাড়া ও বাজার পাড়া জনমানব শূন্য।
কোনার পাড়ার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ জানান ঘরের কোন জিনিসপত্র তারা নিয়ে আসতে পারেনি। থেমে থেমে গোলা বর্ষন অব্যাহত আছে। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তবর্তী তমব্রæ, বাইশফাঁড়ি ও ভাজাবুনিয়ার বাসিন্দারা এখন চরম আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিকে, চলমান অস্থিরতায় ঘুমধুম সীমান্তের ছয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন।
ধুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য দীল মোহাম্মদ জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমান্তে বসবাসকারীদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে গোলাগুলির আতংকে ইউনিয়নের ৩ গ্রামের সহ¯্রাধিক মানুষ বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সোমবার মর্টার শেলের আঘাতে দুই জন নিহত হওয়ার পর স্থানীয়দের মাঝে আতংক আরো বেড়েছে।
নিহতদের মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর মান্নান।
নিহতের ঘটনায় বিজিবির প্রতিবাদ ঃ
সীমান্তে মর্টার শেলের দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবাদ জানানোর কথা জানিয়েছেন রিজিওন কমন্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোরশেদ আলম। তিনি বলেন, আশ্রয় নেওয়া ১০৬ জন বিজিপি সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ করে থাকা খাওয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ৯ জনকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে বিজিবির পাহারায় কঠোর নিরাপত্তায় চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে রবিবার রাতে দুইজন এবং সোমবার সকালে সাতজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে কঠোর নিরাপত্তায় তাদের সেবা দেয়া হচ্ছে। শিগগির তাদের সে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। মর্টারশেলের আঘাতে নিহতদের বিষয়ে লিখিত আকারে মিয়ানমারকে প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও সীমান্ত পথ ব্যবহার করে আরো কয়েক শত বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সুত্র গুলো।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তে উত্তেজনা ওপার থেকে রোহিঙ্গা এবং বিজিপি সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে এমন আশঙ্কায় সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সাগরে কোস্টগার্ড সদস্যরাও রয়েছে। কোন অবস্থায় আমরা রোহিঙ্গা কিংবা অন্য কাউকে ঢুকতে দিবো না।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ( আরএমও ) ডা. আশিকুর রহমান বলেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির দুই সদস্যকে আহত অবস্থায় রবিবার রাত আটটার দিকে হাসপাতালে আনা হয়। চিকিৎসাধীন ওই দুই সদস্য হলেন, রি লি থাইন (২২) ও জা নি মং (৩০)। সোমবার সকালে আরও সাতজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আমরা তাদের সেবা দিচ্ছি।
সীমান্তের ওপারে রাতভর গোলাবর্ষণ ঃ
সোমবার সন্ধ্যার পর তমব্রæ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের তমব্রæ লেফট ক্যাম্প, তমব্রæ রাইট ক্যাম্প ও ঘুমধুম সীমান্তের ঢেকুবুনিয়া এলাকা জুড়ে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরকান আর্মির সদস্যরা তমব্রæ রাইট ক্যাম্প পুনঃ নিয়ন্ত্রনে নেওয়ার পর ঘুমধুম সীমান্তের ঢেকুবুনিয়া দখলের জন্য চারদিক ঘেরাও করে মাঝে মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওইসব স্থানে গোলাগুলিতে দুই পক্ষের প্রায় তিন শতাধিক নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা একজন বিজিপি সদস্য। এর মধ্যে মিয়ারমারের সরকারি বাহিনীর শতাধিক সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন বলে ওই বিজিপি সদস্য জানিয়েছেন।